
একদিনের প্যারিস
এর আগে বিজ্ঞানী সন্মেলনে ঘুরে এসেছি অস্ট্রেলিয়া থেকে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর দেখে এসেছি। সে আজ থেকে প্রায় বছর আটেকের আগের কথা। সেই লেখা আজও লিখে উঠতে পারিনি। তবু প্রতিটা মুহূর্ত আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ফিরে যেতে পারি সেই এক সপ্তাহের সাত টা দিনে। তবে ইউরোপ এর অন্যতম প্রাচীন শহর প্যারিস এর কাছে সেই অভিজ্ঞতা যেন কোথাও ফিকে হয়ে যায়। তাই প্রথম থেকেই শুরু করি, কি ভাবে যাবার সুযোগ এল, কি ভাবেই বা পৌঁছলাম, আর কেমনই বা লাগল আমার চোখে দেখা প্রথম ইউরোপ।
সুযোগ টা এসেছিল একটা ইমেইল মারফত, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে প্যারিসে, একটা সন্মেলনে যোগ দেবার জন্য। আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি, সেই বিষয়ের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হবে এই সন্মেলন। কিন্ত যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হবে কয়েক জনকে। চোখ বন্ধ করে দিলাম আবেদন করে। মাস কেটে গেলো, উত্তর আর আসে না। তারপর এল সুখবর, অক্টোবর মাসের প্রথমে। আমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছল আমার ইমেইল এ। তার মানে যাত্রা করা যেতে পারে। সেই দিন থেকে যাবার এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত কাটল সব কাগজ পত্র তৈরি করতে - ভিসা হল, টিকিটও কাটা হল, ইউনিভার্সিটি থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সারও আয়োজন হল। চিনে টাকা পরিবর্তন করে ইউরো নিলাম। ক্রেডিট কার্ড গুলো সঙ্গে নিয়ে নিলাম, বলা যায় না কোথায় কখন কাজে লেগে যায়। এই সময় বলা দরকার, উদ্যোগকারীরা অনেক সাহায্য করেছেন আমায়, যখন যে ভাবে চিঠির দরকার হয়েছে, পেয়েছি।
এর মধ্যে আমি আরও একটা কাজ করলাম। ভালো করে চোখ বোলালাম সন্মেলনের সময় সূচিতে, যেটা শুরু হচ্ছে ১২ তারিখ থেকে আর চলবে ১৫ তারিখ অবধি – মানে মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার। আমি টিকিট কেটেছি এমনভাবে যাতে আমি পৌঁছব রবিবার রাতে, আর ফিরে আসার জন্য বেরিয়ে পরবো শনিবার বিকেলে। সন্মেলনটা যেখানে হচ্ছে, সেই জায়গাটার নাম Saint-Remy-les-Chevreuses। শহরের ম্যাপ দেখে যা বুঝলাম, জায়গাটা প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে, প্রায় গ্রাম বলা চলে। শহরের মেট্রো ম্যাপ এ সবচেয়ে লম্বা যে রুট, তার প্রথম স্টেশন হচ্ছে এয়ারপোর্ট আর শেষ স্টেশন এই জায়গাটা। প্রায় ১ ঘণ্টার ওপর সময় লাগে এক পিঠ যেতে। আশেপাশে কিছু নেই, একটা ট্রেন স্টেশন, বাস ডিপো, কিছু অল্প দোকান নিয়ে ছোট একটা গ্রাম। তার ওপর সন্মেলন চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি, যার পর শরীর দিলেও, মন সায় দেবে না শহরে আসার। তাই যা করার, যা দেখার দেখতে হবে একদিনেই – সোমবার হতে হবে সেই দিন। মঙ্গলবার সকালে পৌছলেই হবে গ্রামে। তাই এবার ভালো করে পরিকল্পনা করতে বসলাম। একদিনে কিভাবে প্যারিস দেখা সম্ভব – কি কি দেখব, আর কি কি এবারের মত বাদ দেব।
যাবার আগের প্রস্তুতি
প্রথমে বসলাম যাতায়াত নিয়ে। যে সব ওয়েবসাইট থেকে ইনফর্মেশন পেয়েছিলাম, তার একটা লিস্ট নীচে দিয়ে রাখব, যাতে পরে কাজে লাগে। যাইহোক, আমার যাওয়া আর আসা দুটোই এয়ার চায়না তে। গুয়াংযো থেকে বেজিং হয়ে প্যারিস এর Charles De Gaulle (CDG) এয়ারপোর্ট । আরও একটা এয়ারপোর্ট আছে প্যারিস শহরে – Orly এয়ারপোর্ট। আমি পৌছব স্থানীয় সময় বিকেল ৫-৪৫ এ। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে সময় আর পয়সা দুই বেশি লাগবে, তাই স্থির করলাম ট্রেন এ যাব। প্যারিস শহরে ১৬ টারও বেশি লাইন আছে, ৩০০ ওরও বেশি স্টেশন। এর মধ্যে যে লাইন টা শহরের কেন্দ্রস্থল কে আশেপাশের জায়গা গুলোর (যাকে ইংরিজিতে বলা হয়, suburb) সাথে যুক্ত করে, সেই লাইন টার নাম RER। দেখে বুঝলাম RER-B লাইন এর ট্রেন ধরতে হবে আমাকে CDG থেকে আর এই লাইনের শেষ স্টেশন হচ্ছে সন্মেলনের জায়গা। ট্রেন যাবে শহরের মধ্যে দিয়ে, এই মাথা থেকে ওই মাথা – মাঝে পরবে প্যারিস শহর। শনিবার রাতে নেমে যদি আমি এই লাইনের মাঝের কোন স্টেশন এর আশেপাশে থেকে যেতে পারি, আর সেই জায়গা টা যদি শহরের মধ্যে হয়, তাহলে সুবিধা হবে। মাঝের স্টেশন গুলো দেখে ঠিক করলাম থাকা যেতে পারে St Michel/Nôtre Dame এর আশেপাশে। প্রচুর দেখার জিনিষ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, সোমবার টা ভালো ভাবে কাটানো যাবে। মঙ্গলবার সকালে বেরিয়ে আবার ওই স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরে সোজা চলে যাব সন্মেলনের জায়গায়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ – এবার দেখতে হবে থাকার জায়গা। উদ্যক্তরা থাকার ব্যবস্থা করবেন শুধুমাত্র সন্মেলনের দিন গুলোর জন্যে (মানে ১২ থেকে ১৫) – তাই বাকি দিনগুলো আমাকে ভাবতে হবে। ১০-১২ তারিখ এর জন্য স্থির করলাম মোটামুটি ভালো একটা হোটেল দেখব, আর শেষ দিন টা শহরে না ফিরে, সন্মেলন শেষ হবার পর ওই গ্রামেই থেকে যাব কোথাও। সেই মত, হোটেল খুঁজতে বসলাম। অনেক টালবাহানা আর হিসেবপত্তর করার পর, প্রথমে বুক করলাম যে হোটেল টা তার নাম - Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés (ঠিকানা-14 Rue de la Sorbonne, Paris, France, 75005)। স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ। আর সকালের ব্রেকফাস্ট টা complementary। শেষের দিনটা ঠিক করলাম থাকব একটা home stay তে – নাম chambre d'hôte (ঠিকানা- 4 rue Henri Janin, Saint-Rémy-lès-Chevreuse, France, 78470)।
এবার আসল কাজ – কি ভাবে একদিনে প্যারিস দেখা যায়। হাতে আছে ১১ তারিখ টা শুধু। পড়াশুনো করতে শুরু করলাম অবসর সময়ে। প্রচুর আর্টিকেল আছে ইন্টারনেট এ, সেগুলো ভালো ভাবে পরে একটা ম্যাপ বানালাম। মোবাইল এর ম্যাপ খুলে জায়গাগুলো মার্ক করলাম, আর কিভাবে সেগুলো কভার করা যায়, তার একটা প্ল্যান করলাম। শেষে বুঝলাম, দুটো জায়গা আছে যেখানে ভিড় হবে প্রচুর আর টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। টিকিটের জন্য লাইন দেওয়া মানে সব সময় ওখানেই চলে যাওয়া। অনলাইন টিকিট কাটা যায় যেখানে দিন আর সময় নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেই মতো ১১ তারিখের সকালে ১২ টার সময় বুক করলাম ল্যুভর মিউজিয়াম আর দুপুর ৩ টের সময় আইফেল টাওয়ার। ঠিক করলাম হোটেল থেকে সকালে বেরিয়ে ল্যুভর যাবার পথে কিছু জিনিষ দেখবো, ল্যুভর থেকে আইফেল যাবার পথে কিছু, আর তারপরেও যদি শরীর দেয়, তাহলে ফেরার পথে কিছু। যেদিন পৌঁছব, সেদিন রাতে কিছু খেয়ে শুয়ে পরলেই হবে, কিন্তু ১১ তারিখ টা রাতে খাবার জন্য প্যারিস এর অন্যতম পুরনো একটা রেস্তোরায় টেবিল বুক করলাম। নাম – Le Procope, স্থাপিত ১৬৮৬ সালে। তাহলে যাওয়া ঠিক, থাকা ঠিক, খাওয়ার ব্যবস্থাও ঠিক, ঘোরাও মোটামুটি নিশ্চিত। এবার গিয়ে পরতে পারলেই হোল।