top of page
একদিনের প্যারিস

এর আগে বিজ্ঞানী সন্মেলনে ঘুরে এসেছি অস্ট্রেলিয়া থেকে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর দেখে এসেছি। সে আজ থেকে প্রায় বছর আটেকের আগের কথা। সেই লেখা আজও লিখে উঠতে পারিনি। তবু প্রতিটা মুহূর্ত আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ফিরে যেতে পারি সেই এক সপ্তাহের সাত টা দিনে। তবে ইউরোপ এর অন্যতম প্রাচীন শহর প্যারিস এর কাছে সেই অভিজ্ঞতা যেন কোথাও ফিকে হয়ে যায়। তাই প্রথম থেকেই শুরু করি, কি ভাবে যাবার সুযোগ এল, কি ভাবেই বা পৌঁছলাম, আর কেমনই বা লাগল আমার চোখে দেখা প্রথম ইউরোপ।

সুযোগ টা এসেছিল একটা ইমেইল মারফত, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে প্যারিসে, একটা সন্মেলনে যোগ দেবার জন্য। আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি, সেই বিষয়ের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হবে এই সন্মেলন। কিন্ত যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হবে কয়েক জনকে। চোখ বন্ধ করে দিলাম আবেদন করে। মাস কেটে গেলো, উত্তর আর আসে না। তারপর এল সুখবর, অক্টোবর মাসের প্রথমে। আমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছল আমার ইমেইল এ। তার মানে যাত্রা করা যেতে পারে। সেই দিন থেকে যাবার এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত কাটল সব কাগজ পত্র তৈরি করতে - ভিসা হল, টিকিটও কাটা হল, ইউনিভার্সিটি থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সারও আয়োজন হল। চিনে টাকা পরিবর্তন করে ইউরো নিলাম। ক্রেডিট কার্ড গুলো সঙ্গে নিয়ে নিলাম, বলা যায় না কোথায় কখন কাজে লেগে যায়। এই সময় বলা দরকার, উদ্যোগকারীরা অনেক সাহায্য করেছেন আমায়, যখন যে ভাবে চিঠির দরকার হয়েছে, পেয়েছি।

 

এর মধ্যে আমি আরও একটা কাজ করলাম। ভালো করে চোখ বোলালাম সন্মেলনের সময় সূচিতে, যেটা শুরু হচ্ছে ১২ তারিখ থেকে আর চলবে ১৫ তারিখ অবধি – মানে মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার। আমি টিকিট কেটেছি এমনভাবে যাতে আমি পৌঁছব রবিবার রাতে, আর ফিরে আসার জন্য বেরিয়ে পরবো শনিবার বিকেলে। সন্মেলনটা যেখানে হচ্ছে, সেই জায়গাটার নাম Saint-Remy-les-Chevreuses। শহরের ম্যাপ দেখে যা বুঝলাম, জায়গাটা প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে, প্রায় গ্রাম বলা চলে। শহরের মেট্রো ম্যাপ এ সবচেয়ে লম্বা যে রুট, তার প্রথম স্টেশন হচ্ছে এয়ারপোর্ট আর শেষ স্টেশন এই জায়গাটা। প্রায় ১ ঘণ্টার ওপর সময় লাগে এক পিঠ যেতে। আশেপাশে কিছু নেই, একটা ট্রেন স্টেশন, বাস ডিপো, কিছু অল্প দোকান নিয়ে ছোট একটা গ্রাম। তার ওপর সন্মেলন চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি, যার পর শরীর দিলেও, মন সায় দেবে না শহরে আসার। তাই যা করার, যা দেখার দেখতে হবে একদিনেই – সোমবার হতে হবে সেই দিন। মঙ্গলবার সকালে পৌছলেই হবে গ্রামে। তাই এবার ভালো করে পরিকল্পনা করতে বসলাম। একদিনে কিভাবে প্যারিস দেখা সম্ভব – কি কি দেখব, আর কি কি এবারের মত বাদ দেব।

যাবার আগের প্রস্তুতি

প্রথমে বসলাম যাতায়াত নিয়ে। যে সব ওয়েবসাইট থেকে ইনফর্মেশন পেয়েছিলাম, তার একটা লিস্ট নীচে দিয়ে রাখব, যাতে পরে কাজে লাগে। যাইহোক, আমার যাওয়া আর আসা দুটোই এয়ার চায়না তে। গুয়াংযো থেকে বেজিং হয়ে প্যারিস এর Charles De Gaulle (CDG) এয়ারপোর্ট । আরও একটা এয়ারপোর্ট আছে প্যারিস শহরে – Orly এয়ারপোর্ট। আমি পৌছব স্থানীয় সময় বিকেল ৫-৪৫ এ। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে সময় আর পয়সা দুই বেশি লাগবে, তাই স্থির করলাম ট্রেন এ যাব। প্যারিস শহরে ১৬ টারও বেশি লাইন আছে, ৩০০ ওরও বেশি স্টেশন। এর মধ্যে যে লাইন টা শহরের কেন্দ্রস্থল কে আশেপাশের জায়গা গুলোর (যাকে ইংরিজিতে বলা হয়, suburb) সাথে যুক্ত করে, সেই লাইন টার নাম RER। দেখে বুঝলাম RER-B লাইন এর ট্রেন ধরতে হবে আমাকে CDG থেকে আর এই লাইনের শেষ স্টেশন হচ্ছে সন্মেলনের জায়গা। ট্রেন যাবে শহরের মধ্যে দিয়ে, এই মাথা থেকে ওই মাথা – মাঝে পরবে প্যারিস শহর। শনিবার রাতে নেমে যদি আমি এই লাইনের মাঝের কোন স্টেশন এর আশেপাশে থেকে যেতে পারি, আর সেই জায়গা টা যদি শহরের মধ্যে হয়, তাহলে সুবিধা হবে। মাঝের স্টেশন গুলো দেখে ঠিক করলাম থাকা যেতে পারে St Michel/Nôtre Dame এর আশেপাশে। প্রচুর দেখার জিনিষ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, সোমবার টা ভালো ভাবে কাটানো যাবে। মঙ্গলবার সকালে বেরিয়ে আবার ওই  স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরে সোজা চলে যাব সন্মেলনের জায়গায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

যেমন ভাবা তেমন কাজ – এবার দেখতে হবে থাকার জায়গা। উদ্যক্তরা থাকার ব্যবস্থা করবেন শুধুমাত্র সন্মেলনের দিন গুলোর জন্যে (মানে ১২ থেকে ১৫) – তাই বাকি দিনগুলো আমাকে ভাবতে হবে। ১০-১২ তারিখ এর জন্য স্থির করলাম মোটামুটি ভালো একটা হোটেল দেখব, আর শেষ দিন টা শহরে না ফিরে, সন্মেলন শেষ হবার পর ওই গ্রামেই থেকে যাব কোথাও। সেই মত, হোটেল খুঁজতে বসলাম। অনেক টালবাহানা আর হিসেবপত্তর করার পর, প্রথমে বুক করলাম যে হোটেল টা তার নাম - Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés (ঠিকানা-14 Rue de la Sorbonne, Paris, France, 75005)। স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ। আর সকালের ব্রেকফাস্ট টা complementary। শেষের দিনটা ঠিক করলাম থাকব একটা home stay তে – নাম chambre d'hôte (ঠিকানা- 4 rue Henri Janin, Saint-Rémy-lès-Chevreuse, France, 78470)।

এবার আসল কাজ – কি ভাবে একদিনে প্যারিস দেখা যায়। হাতে আছে ১১ তারিখ টা শুধু। পড়াশুনো করতে শুরু করলাম অবসর সময়ে। প্রচুর আর্টিকেল আছে ইন্টারনেট এ, সেগুলো ভালো ভাবে পরে একটা ম্যাপ বানালাম। মোবাইল এর ম্যাপ খুলে জায়গাগুলো মার্ক করলাম, আর কিভাবে সেগুলো কভার করা যায়, তার একটা প্ল্যান করলাম। শেষে বুঝলাম, দুটো জায়গা আছে যেখানে ভিড় হবে প্রচুর আর টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। টিকিটের জন্য লাইন দেওয়া মানে সব সময় ওখানেই চলে যাওয়া। অনলাইন টিকিট কাটা যায় যেখানে দিন আর সময় নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেই মতো ১১ তারিখের সকালে ১২ টার সময় বুক করলাম ল্যুভর মিউজিয়াম আর দুপুর ৩ টের সময় আইফেল টাওয়ার। ঠিক করলাম হোটেল থেকে সকালে বেরিয়ে ল্যুভর যাবার পথে কিছু জিনিষ দেখবো, ল্যুভর থেকে আইফেল যাবার পথে কিছু, আর তারপরেও যদি শরীর দেয়, তাহলে ফেরার পথে কিছু। যেদিন পৌঁছব, সেদিন রাতে কিছু খেয়ে শুয়ে পরলেই হবে, কিন্তু ১১ তারিখ টা রাতে খাবার জন্য প্যারিস এর অন্যতম পুরনো একটা রেস্তোরায় টেবিল বুক করলাম। নাম – Le Procope, স্থাপিত ১৬৮৬ সালে। তাহলে যাওয়া ঠিক, থাকা ঠিক, খাওয়ার ব্যবস্থাও ঠিক, ঘোরাও মোটামুটি নিশ্চিত। এবার গিয়ে পরতে পারলেই হোল।

আরও লেখা

Paris - 1
cdg-to-paris.png
একদিনের প্যারিস
Paris 2

যাবার দিন – রবিবার (১০ই নভেম্বর)

এই করতে করতে এসে পরল যাবার দিন। দিনটা ১০ই নভেম্বর। সকালে ৮ টা ১০ এর ফ্লাইট গুয়াংযো থেকে, প্রথমে যাওয়া বেজিং, সেখান থেকে প্যারিস। আমার সঙ্গের লাগেজ বলতে একটা পিঠের ব্যাগ যাতে আমার ক্যামেরা আছে, একটা ল্যাপটপ ব্যাগ যাতে ল্যাপটপের সাথে পাসপোর্ট আছে, আর একটা ট্রলি যাতে আমি ভরেছি গরম জামা শুধু। যখন দেখেছি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে ৭-১০ ডিগ্রির ভেতরে, এবং আগামী দিনগুলোতে সেটা আরও কমবে, তখন তড়িঘড়ি গিয়ে একটা জ্যাকেট কিনে এনেছি। ইউনিভার্সিটি এর সামনে থেকে এয়ারপোর্ট এর বাস ছাড়ে আমাদের, সকালের প্রথম বাসে চেপে বসলাম, তখন ঘড়িতে বেজেছে ৫ টা। শহর তখনও উঠিউঠি করছে, রাস্তায় কিছু মালবোঝাই লরি শহরের খাদ্যের আয়োজনে ব্যস্ত। একজন স্টুডেন্ট এসেছিল আমাকে বাসে তুলে দিতে, দরকার ছিল না, কিন্তু আমার বসের হুকুম সেই বা অমান্য করে কি করে। তাকে টাটা করে বাস চলল এয়ারপোর্ট এর দিকে, গুটিকয়েক যাত্রীকে সঙ্গী করে।

নির্দিষ্ট সময়ে প্লেন ছাড়ল, ১১ টায় বেজিং পৌঁছে ট্রান্সিট, হাতে সময় আড়াই ঘণ্টা মতো। তাড়াহুড়ো করে পরের প্লেন এর চেক ইন সারলাম, মাথায় তখন খালি ঘুরছে শেষ বার চায়না তে প্লেন মিস করার কথা, এই একই কারনে। যাই হোক, সময় মতো সব হলও, প্যারিস এর প্লেন ছাড়ল ঘড়িতে তখন দুপুর ১ টা বেজে ৩০ মিনিট। সামনে লম্বা যাত্রাপথ – প্রায় ৫০০০ মাইল পথ পাড়ি দেবে এই এয়ারবাস ১১ ঘণ্টায়। তাই সিট নিয়েছিলাম চলাচল করার করিডরের পাশে, সামনের সিট এর সারি ফাঁকা আর তার সামনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা। ৩ জনের সিটে আমার পাশে দুই মহিলা যাত্রী – দুজনেই আমার সমবয়সী এবং কথা থেকে বোঝা যায়, তারা ফ্রান্স এরই অধিবাসী। ইউরোপিয়ান চরিত্রের নমুনা মিলল যাত্রাপথেই। রোদ এর পথ আটকে ঘুমোচ্ছিল আমার দুই সহযাত্রী, আর যাত্রা পথের একঘেয়েমি দূর করতে পেছনের যাত্রী দের কেউ কেউ উঠে আসছিলেন সামনের খোলা জায়গাটায়। এদেরই একজন আমাদের সামনের ফাঁকা সিটে বসে জানালা টা খুলে দিচ্ছিলেন, আর যার ফলে সুযোগ পেয়ে বাইরের সূর্য ঢুকে পড়ছিল ভেতরে। ঘুমের ব্যাঘাত হতে আমার পাশের সহযাত্রীটি দুবার বিরক্তি সূচক শব্দ করলেন, তিন বারের বার আর থাকতে না পেরে জানালাটাই ধরে বেশ জোরের সাথেই দিলেন নামিয়ে। ভাষা যেখানে মত প্রকাশের অন্যতম অন্তরায়, সেখানে এই আচরণ হয়তো বা সঙ্গত, কিন্তু ভাবলাম – আমরা পারতাম কি প্রথমেই এই আচরণ করতে নাকি বোঝানোর চেষ্টাতে কিছুটা সময় খরচ করতাম আগে? যেখানে আমি যাচ্ছি, এই নমুনা কি সেই সমগ্র জাতির ব্যবহারের প্রতিনিধি? অপেক্ষা তো আর কয়েক ঘণ্টার, তারপর দেখবো। ততক্ষণ আমি মন দিলাম খাবারে – স্বীকার করতেই হবে এয়ার চায়না খেতে দেয় ভালই, আর অনেকবার। ওঠার পর লাঞ্চ, তারপর স্ন্যাক্স, আবার নামার আগে ডিনার। আর এর মাঝে ড্রিংক, যাতে নরম থেকে গরম সব রকম পানীয়ই থাকে। এই সব খেয়েও আমি উঠে গিয়ে এয়ারহোস্ট দের কেবিন থেকে চার বার কফি খেয়ে এসেছি।

একঘেয়ে যাত্রাও একসময় শেষ হল, ঘড়িতে দেখি রাত ১ টা। সময়ের পার্থক্যটা আগে থেকেই হিসেব করা ছিল, একদিন পিছিয়ে পরেছি, এখন এখানে বেজেছে বিকেল ৬ টা। প্লেন থেকে বেরিয়ে লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে লেগে গেলো আরও ঘণ্টা খানেক। এরপর ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতে লাগল আরও আধঘণ্টা মতো। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ২ থেকে  স্বয়ংক্রিয় ট্রেনে চেপে বিনামুল্যে চলে আসা যায় টার্মিনাল ৩ যেখান থেকে RER-B লাইন এর ট্রেন ছাড়ে। টিকিট কাটতে লাগল ১০ ইউরো মতো, হাতে টিকিট নিয়ে কলকাতা মেট্রোর মতো মেশিনে ঢুকিয়ে ঘোরানো গেট পেরিয়ে পা রাখলাম ট্রেন স্টেশনে। স্টেশন টা নিচে, তার দুটো প্ল্যাটফর্ম – একটাতে ট্রেন শহরে যায়, আর একটা দিয়ে এয়ারপোর্টে আসে।  স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডে সময় গুলো দেখে বুঝলাম এখানে দুরকমের ট্রেন আছে – একটা হাইস্পিড যেটা সব স্টেশনে থামবে না, আর একটা রেগুলার। আমার গন্ত্যব্যে দুরকম ট্রেনই যাবে, তাই অপেক্ষা করলাম প্রথম রেগুলার ট্রেন টা ছেড়ে দিয়ে। মাঝের সময়টা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে কাটাতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়লো। ওপরে এয়ারপোর্ট চত্বর যেন আধুনিক প্যারিসের প্রতিনিধি আর নিচে আধো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা ট্রেন স্টেশন, লাইনের পাশের নোনা ধরা দেওয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে – যেন প্রথম পরিচয় করায় শহরের আত্মার সাথে, মনে করিয়ে দেয় আমরা এসেছি সেই শহরে যা আজও তার প্রাচীনত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত। ওপরের শহরের আলোকজ্জ্বল আধুনিকতার নিচে একটুকরো পুরনোকে বুকে জড়িয়ে সে আজও সাখ্য দেয় পুরনো প্যারিসের যার জন্ম সেই ২৫৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে PARISSI নামক এক উপজাতির হাত ধরে।

ট্রেন এলো যথাসময়ে, আর আমিও আমার জিনিসপত্র নিয়ে চেপে বসলাম তাতে। ঘড়িতে তখন প্রায় ৮ টা। স্টেশনের পর স্টেশন ছাড়িয়ে চললাম। ট্রেনে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মিলিয়ে যাত্রী খুব অল্প নয়, লোক উঠছে-নামছে, আমি মোবাইলের স্ক্রীনে নজর রেখেছি, জানি কখন আমায় নামতে হবে। Gare du Nord (যেখান থেকে Eurostar ট্রেন লন্ডন আর প্যারিস কে যুক্ত করে) আর Chatelet Les Halles স্টেশন ছাড়িয়ে এলো St Michel-Nôtre Dame স্টেশন।  নেমে পরলাম, নির্দেশিকা অনুসরণ করে বেরুলাম Saint-Germain Boulevard এ, মাটির তলা দিয়ে লম্বা পথ পেরিয়ে আসতে লাগল প্রায় মিনিট পাঁচেক। আর বেরিয়েই বুঝতে পারলাম ঠাণ্ডাটা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর কেঁপে উঠল, গায়ের পুলওভার টা গলা অবধি টেনে ওপরে এসে দাঁড়ালাম। যেখানে বেরুলাম, সেই জায়গাটা একটা চৌমাথা। ম্যাপটা মোটামুটি মাথায় ছিল, সেই মতো দিক আন্দাজ করে হাঁটা শুরু করলাম। চৌমাথা থেকে বাঁদিকে Saint-Germain Boulevard ধরে মিনিট পাঁচেক মতো হেঁটে আবার বাঁদিকে বেঁকে কিছুটা গিয়ে একটা ছোট রাস্তা ডানদিকে ঢুকে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে ডান হাতে পড়ল হোটেলটা -  Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés। হোটেলের সামনের রাস্তায় বোধহয় গাড়ির পারকিং, সরু রাস্তার বাঁদিকে সোজা উঠে গেছে ৫ তলা বাড়ি যার বিস্তৃতি রাস্তার এই মাথা থেকে ওই মাথা। ম্যাপে দেখলাম সেটা University Paris-Sorbonne। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ৯ টা।

হোটেলের পেমেন্ট করাই ছিল, বাকি ফর্মালিটি সেরে ঘরে ঢুকে পরলাম। বেশ সাজানো গোছানো হোটেল, তিন তারা হোটেলের মতই। ঘরে ঢুকে বাড়িতে জানিয়ে প্রথম এক কাপ কফি বানালাম হোটেলের ইলেকট্রিক কেটলিতে। যদিও কেটলি, কফি, চিনি সবই আমার ব্যাগে ছিল, সেগুলো বের না করে হোটেলের জিনিসগুলো দিয়েই কাজ সারলাম। কফি খেয়ে, হাত মুখ ধুয়ে, একটু ফ্রেশ হয়ে আবার বেরুলাম। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেটা ধরেই গেলাম, চৌমাথা ছাড়িয়ে সোজা এগোলাম। রাস্তার দু পাশে দোকানের সারি, এই রাতে সবই প্রায় বন্ধ, রাস্তায় টুরিস্ট ও প্রায় নেই বললেই চলে। এই জায়গা থেকেই শুরু বিখ্যাত ল্যাটিন কোয়াটার। কিছুদুর হেঁটে যেতেই দেখতে পেলাম একটা ব্রিজ, তলা দিয়ে বয়ে চলেছে সেইন নদী। রাস্তাটা এখানে অনেকটা চওড়া, ব্রিজের আগে দুভাগে ভাগ হয়ে নদীর পাশ বরাবর চলে গেছে দুদিকে। ম্যাপে দেখলাম এই ব্রিজটার নাম Pont Saint-Michel। যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে এই ত্রিমাথা, তার একটু আগেই একটা ত্রিভুজ রাস্তার মাঝখানে, দুদিক দিয়ে রাস্তা এসে একজায়গায় মিললে যেমন হয়, তেমন। আর সেই ত্রিভুজের মাঝখানে একটা ফোয়ারা, যার নাম Fontaine Saint-Michel। ১৮৬০ সালে গ্যাব্রিয়েল দেভিউডের বানানো এই স্থাপত্যের মাঝখানে সেন্ট মাইকেলের ব্রোঞ্জের মূর্তি যার হাতে উদ্যত তরবারি প্রস্তুত পায়ের নিচের অসুর বা ডিমন বধের জন্য। দুদিক দিয়ে উঠেছে চারটে লাল মার্বেলের স্তম্ভ যা প্রতিনিধিত্ব করছে চার গুণের – ইংরেজিতে যাদের নাম prudence, Fortitude, Justice আর Temperance। ফোয়ারার সামনে দুদিকে দুটো ড্রাগন, যাদের মুখ দিয়েও জলের ফোয়ারা।

   

ব্রিজটা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে একটু হেঁটে এলাম, নদীর ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে দাঁড়ানো যায় না, তাও অনেক লোক এই রাতেও নদীর পাড়ের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে, গল্প করছে, ছবি তুলছে। নদীতে ছোট সুদৃশ্য নৌকাও চলতে দেখলাম, যেরকম দেখেছি আমাদের ওখানে পার্ল নদীতে। নদীর উলটো দিকে, মানে যেদিক থেকে আমি এলাম, কিছু সুভেনিরের দোকান তখনও খোলা। আমার বাঁদিকে পড়লো একটা অট্টালিকা – মাপে দেখলাম সেটা প্যারিস পুলিশের কার্যালয়, নাম Prefecture de Police de Paris। আর আমার সামনে, অন্ধকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নত্রে দামে ক্যাথেড্রাল। আসার আগেই জেনেছিলাম, ক্যাথেড্রাল বন্ধ, কাজ চলছে। ২০১৯ এর ১৫ই এপ্রিল এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই স্থাপত্য, তার পর থেকেই অনুগামী ও দর্শকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাথেড্রালের দরজা। আমি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম সেখানে, শহরের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়েও অনুভব করা যায় যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে কত ইতিহাসের সাক্ষ্যে, কান পাতলে এখনও যেন শোনা যায় তার দীর্ঘশ্বাস। গা নিজের অজান্তেই ছমছম করে ওঠে। রাত বাড়ছে, হোটেলে ফিরতে হবে, শরীরটাও আর চলছে না। ফিরলাম উলটো মুখে। পেছনে ফেলে আসা পথে দাঁড়িয়ে থাকল নত্রে দামে, অপেক্ষায় কবে ফিরবে সে তার পুরনো গরিমায়।

হোটেলে ফিরে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া ব্রেড আর কফি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা লেপের তলায়। আসার আগে জেনে এসেছি, কাল সকাল ৭টা থেকে ব্রেকফাস্ট শুরু, চলবে ১০টা অবধি। রুমটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, খাটে শুয়ে কালকের প্ল্যান টা ভালো করে ঝালিয়ে নিলাম মোবাইলের ম্যাপে। কাল ঠিক করেছি সাড়ে ৭ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। আজকের ক্লান্ত শরীর কাল উঠতে পারবে তো সময়ে? জানি না, মোবাইলের অ্যালার্মই ভরসা। এখন বেঝেছে সাড়ে ১০টা। আজকের তোলা ছবি গুলো দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম সেটা বুঝতেই পারলাম না।

আরও লেখা

একদিনের প্যারিস

পরের দিন – সোমবার (১১ই নভেম্বর)

ঘুম ভাঙল বেশ সকালে, ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৬ টা। উঠে কফি খেয়ে তৈরি হয়ে নিচে নামলাম। ব্রেকফাস্টের রুম টা খুঁজে নিয়ে ঢুকে পরলাম। ভেতরে দেখি প্রচুর খাবার সাজানো – বুফে সিস্টেম। প্রায় ১০-১২ রকমের ব্রেড, ফলের জুস, কাটা ফল, মাংস, ডিম, চা, কফি – সে এক এলাহি ব্যাপার। যাই হোক, আমি কয়েক রকমের ব্রেড আর গোটা দুয়েক ডিম সেদ্ধ নিয়ে এসে বসলাম। এত সকালে অত বড় ডাইনিং হলে আমি একা। খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম একজন মেয়ে ভেতরে রান্না ঘরে কাজ করছে, কিছু ক্ষণ পরে পরে এসে ডাইনিং হলের সাজানো খাবারের তদারকি করে যাচ্ছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম – ‘কফি পাওয়া যাবে?’। যদিও কফি তৈরির মেশিন একটা দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সেটা কি করে চালাতে হয়, আমি জানি না। মেয়েটা এশিয়ান, খুব অল্প বয়স, দেখে মনে হয় কলেজে পড়ে। হেসে বলল, ‘আপনি কি চায়না থেকে আসছেন?’ আমি অবাক হয়েছি দেখে আরও একটু ভেঙ্গে বলল ‘আমাদের ম্যানেজার বললেন একজন গেস্ট এসেছেন চায়না থেকে, তাই আপনাকে জিজ্ঞ্যাসা করলাম’। আমি যদিও অবাক, তবুও বললাম ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ভারতীয়, কর্মসূত্রে চিনে থাকি, তাই ওখান থেকেই আসছি’। মেয়ে টার ইংরেজি ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তাই প্রশ্ন করলাম, ‘তুমিও কি চিন দেশ থেকে?’। সে বলল, ‘না, আমি থাইল্যান্ডের’। ‘এখানে কি করছ?’ আমার আন্দাজ টা খুব ভুল না জেনে সাহস করে জানতে চাইলাম। মেয়েটি বলল, ‘আমি এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, আর সকালে এখানে কাজ করি, হাতখরচ ছাড়াও ইউনিভার্সিটির ফি কিছুটা দিতে পারি, বাকিটা বাবা পাঠায় দেশ থেকে’।  ‘কি নিয়ে পড়াশুনো করছ?’ প্রশ্নের উত্তরে জানলাম এশিয়ান স্টাডি নিয়ে মেয়েটা আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্রী। সেও জানতে চাইল, আমি কি নিয়ে কাজ করি, এখানে কেন এসেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার কৌতুহল নিবৃত্ত করে কফি আনতে বললাম। সে আমাকে ভেতর থেকে কফি পটে করে গরম কফি, কাপ, চিনি নিয়ে এলো। তার সাথে গল্প করতে করতে গরম দু কাপ কফি খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ৮ টা বেজে গেছে। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, অনেক জায়গার যাবার আছে আজকে। আর দেরি করা চলবে না।

বেরিয়ে প্রথমে কাল যে রাস্তা দিয়ে রাতে হেঁটেছিলাম, সেই রাস্তা ধরে চললাম। নদীর পারে এসে আজকে আর নদী না পেরিয়ে, ডানদিকের রাস্তাটা ধরে এগুলাম। রাস্তা ফাঁকা, দোকান গুলোও সব বন্ধ এখনও। কিছুদুর গিয়ে রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকেছে, আমিও ঢুকলাম, এই রাস্তাটার নাম Rue du Petit Pont। এই রাস্তাটা ধরে একটু হাঁটলাম, কিছুদুরে দেখতে পেলাম Saint Severin চার্চ। এত সকালে বন্ধ চার্চের সামনে দাঁড়িয়েও অনুভব করা যায় গথিক শিল্প কীর্তির এই নমুনার বিশালত্ব, চোখে পড়ে সময়ের হাতের ছাপ এর সর্বাঙ্গে। প্যারিস এর অন্যতম সুন্দর এই চার্চ বাইরে থেকে দেখে কিছু ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, ফিরে চললাম সেই রাস্তা ধরে, এসে পৌঁছলাম নদীর ধারে। নদী পেরিয়ে ব্রিজ টা যে রাস্তার সাথে মিশে গেছে তার নাম Bd du Palais। এই রাস্তা ধরে খানিক এগুলাম, প্রথমে বাঁদিকে পড়লো Sainte-Chapelle আর তার পর Conciergerie। প্রথমের টা চার্চ যেটা এখনও বন্ধ, বাইরে লোকের ভিড় জমছে একটু একটু করে। প্যারিস শহরে এরকম চার্চ প্রচুর ছড়িয়ে আছে আর তার সব কটাই কোন প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। পরের টা একটা অট্টালিকা, যা আগে ব্যবহার হত জেলখানা হিসেবে, আর এখন কোর্ট হিসেবে। এর পর পড়লো আরও একটা ব্রিজ, নাম Pont au Change। সেটা পেরিয়ে রাস্তাটা অনেক দিকে চলে গেছে, আমি বাঁদিকের রাস্তাটা যেটা নদীর পাশ দিয়ে চলেছে সেটা ধরে এগুলাম। এই রাস্তার নাম Quai de la Megisserie, রাস্তার বাঁদিকে নদী আর ডান দিকে দোকানের সারি, স্থানীয় ভাষায় যাদের বলা হয় Brasserie, দোকানের সামনে চাঁদোয়া খাটিয়ে বসার জায়গা। কিছু খোলা যেগুলোতে ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায়, দোকানের বাইরে হরেক রকমের রঙ্গিন পোস্টারে মেনু লেখা। অল্প কিছু মানুষ জনও চোখে পড়লো, যাদের বেশিরভাগ প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন। কেউ হাঁটছেন, কেউ বা জগিং করছেন। গাড়ি খুব অল্প, দু একটা বাস অল্প যাত্রী নিয়ে চলেছে। তবে ভিড় জমেছে জলে, স্বচ্ছ সেইন নদীতে যারা ডানা ঝাপটে শান্ত নদীকে করে তুলছে অশান্ত। জলের সেই অস্থিরতা সংক্রামিত হয়েছে আকাশেও। ছোট একটা কালো মেঘ সকালে উঠেই চোখে পড়েছিল আকাশের পশ্চিমে, সেটা এখন বড় হয়ে পুরো আকাশটাকেই ঢেকে ফেলেছে প্রায়। বুঝলুম দুর্যোগ আছে কপালে। কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো আবার একটা ব্রিজ, ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম সেইন নদীর দুই পাড় কে যোগ করেছে এরকম প্রচুর ব্রিজ, এটার নাম দেখলাম Pont Neuf। ব্রিজে উঠলাম, নদী এখানে খুব চওড়া নয়। ব্রিজের দু পাশে বাতিস্তম্ভের সারি, আর তার প্রত্যেকটাতে অদ্ভুত সুন্দর শিল্পকর্মের নিদর্শন। ব্রিজের অপর প্রান্তে ডানদিকে ঘোড়সওয়ার নেপোলিওনের মূর্তি, আর তার পাশ দিয়ে নিচে নেমে গেছে জেটিতে নামবার সিঁড়ি। এই জেটি থেকেই শুরু হয় সেইন নদীতে নৌকো বিহার। রাস্তার অপর দিকে দিক নির্দেশক চিহ্ন, যার মধ্যে বেশ কয়েকটা আজ আমাকে যেতে হবে। নদী পেরলাম, তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম, আন্দাজে বুঝতে পারছি এই রাস্তাটা ধরে গেলে পৌঁছনো যাবে সেই চৌমাথায় যেখানে আজ সকালে আমি প্রথম নদী পেরিয়েছিলাম। হোটেলে একবার যাওয়া দরকার, ছাতা নিতে হবে, বৃষ্টি আর খুব বেশী দূরে নয়।

Paris 3

আরও লেখা

হোটেলে ফিরে ছাতা নিয়ে বেরলাম। আগের বার ডানদিকে গেছিলাম নদীর দিকে, এবার চললাম বাঁদিকে – নদী যেদিকে তার উলটো দিকে। ম্যাপ দেখে চলছি, বুঝতে পারছি সামনে একটা চৌমাথা থেকে ডানদিকে যেতে হবে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই এলো মোড়টা, আর একটা বড় রাস্তা এসে এই রাস্তাটাকে কেটেছে এই জায়গায় যার ফলে একটা সমবাহু ত্রিভুজের মতো তৈরি হয়েছে যার দুটো পাশাপাশি বাহু এই দুই রাস্তা। এই ত্রিভুজের মাথায় চোখে পড়ল একটা ম্যাক ডোনাল্ড আর একটা বার্গার কিং এর দোকান। সমবাহু ত্রিভুজের যে রাস্তা টা ধরে আমি আসছিলাম, এবার অন্য বাহু টা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম, ম্যাপে দেখলাম এটার নাম Rue de Medicis। Rue শব্দের মানে যে রাস্তা বা Street সেটা জানা ছিল আগেই। ডানদিকে বেঁকে একটু যেতেই একটা গেট, খোলা ছিল, ঢুকে পরলাম। ঢুকে দেখি একটা বাগান, যার দু পাশে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে কাঁকর বেছান রাস্তা। মনে হল ঠিক জায়গাতেই এসেছি, কিন্তু আসার আগে যে ছবি দেখেছিলাম, তার সাথে তো মিলছে না। ঠিক করলাম এগিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে। মেঘ ডাকতে শুরু করেছে, আমি এগুলাম। বাগানের মধ্যে বসার বেঞ্চ, সব খালি, কোনও মানুষের চিহ্ন নেই কোনোদিকে। আরও কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো উঁচু বেদীর ওপর দাঁড়ানো এক পুরুষ মূর্তি, আমি যেদিক থেকে আসছিলাম সেদিকে পেছন করে। সেই মূর্তিকে পাশ কাটিয়ে সামনেই দেখি ছবিতে দেখা সেই বিশাল অট্টালিকা, বুঝলুম এসে পরেছি Jardin du Luxembourg বা Luxembourg Gardens এ। সেই অট্টালিকার সামনে এক সুদৃশ্য সরোবর, আর তাকে দু পাশ দিয়ে জড়িয়ে কাঁকর বেছান রাস্তা। রাস্তার দু পাশে জমি উঠে গেছে উপরের দিকে, সেই উঁচু জায়গায় একদিকে সারি সারি মূর্তি, অন্যদিকে যতদূর চোখ যায়, সবুজের সমারোহ। সরোবরের মাঝখানে এক নারী মূর্তি, তার হাতে জলের কলসি। আর তাকে ঘিরে সেই সাদা জল পাখীদের সমারোহ। আসার আগে পড়েছিলাম ১৬১২ সালে Queen Marie de Medici তৈরি করান এই বাগান। ২৫ হেক্টর জমির ওপর ছড়িয়ে থাকা এই বাগান আজ প্যারিসের অন্যতম প্রধান এক আকর্ষণ আর ওই সুবিশাল অট্টালিকা আজ সরকারি কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। ওই যে সারি দিয়ে দাঁড়ানো সব মূর্তি, তাদের সংখ্যা ১০০ ওরও বেশী, সব মূর্তি অভিজাত আর বিখ্যাত ইউরোপিয়ান আর ফ্রেঞ্চ মহিলাদের – ১৯ শতক থেকে আজ অবধি ক্রমান্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সব শিল্পের নিদর্শন। ছবি তুলতে তুলতেই বৃষ্টি এসে পড়লো, ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলাম বাগান থেকে, যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেই একই রাস্তা ধরে।

ত্রিভুজের মাথায় ফিরে এসে একটু বাঁদিকে বেঁকে এবার চললাম যে রাস্তাটা ধরে, তার নাম Rue Soufflot। এই রাস্তার একবারে শেষে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে Pantheon, যার বাংলা মানে হয় ‘সব ভগবান’। প্যারিসের আকর্ষণীয় ও দ্রষ্টব্য স্থান গুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন, তৈরি হয়েছিল ১৭৬৪ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে। প্রথমে এটা একটা চার্চ হিসেবে তৈরি হলেও, ইতিহাসের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে অনেক বার পরিবর্তিত হয়েছে এর পরিচিতি। আজ এই স্থাপত্য বহন করছে এক উপাসনালয়ের মর্যাদা আর এর নিচে চির নিদ্রায় শায়িত ফ্রান্সের বীর শহিদ আর বিখ্যাত মানুষজন। শুনেছিলাম এর ওপর থেকে নাকি পুরো প্যারিস শহর দেখা যায়, কিন্তু ভাগ্য এবার সঙ্গ দিল না। সকাল ১১ টার আগে Pantheon খুলবে না। কি আর করি, চারপাশে ঘুরে বেড়ালাম একটু, বৃষ্টিতে ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। Pantheon এর বিশাল গম্বুজওলা বাড়িটার সামনে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকে টাউন হল আর ডানদিকে কোর্ট হাউস, Pantheon এর আকার আর ঐতিহ্যের এর সাথে পাল্লা দিতে তারা কোন অংশে কম নয়। হাঁটতে হাঁটতে পেছন দিকে গেলাম, কোথায় যেন পরেছিলাম – ইতিহাস কখনও জীবন্ত হয়, এই জায়গায় এসে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। পাথরের রাস্তা, ঘরবাড়ি, আজও একইরকম ভাবে রয়েছে, ব্যবহৃত হয়, গাড়ি চলে, লোকে বসবাস করে। অতীত যেন এখানে বর্তমানের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ভেতরে ঢুকতে না পারার মন খারাপটা কেটে গিয়ে কখন যেন অবাক বিস্ময়ে ভরে গেছে মন, বুঝতেই পারিনি। বৃষ্টিটা থেমেছিল কিছুক্ষণের জন্য, আবার শুরু হল টিপ টিপ করে। ইতিহাসকে পেছনে রেখে ফিরতেই হল আমাকে। পরের গন্তব্য অনেক দূরে, হেঁটে যেতে সময় লাগবে। নতুন কেনা জ্যাকেটটা ওয়াটার রেসিটাণ্ট, সেটাকে মাথার ওপর তুলে দিয়ে হাঁটা লাগালাম।

একদিনের প্যারিস
Paris 4

যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেই রাস্তা ধরেই এবার চললাম হোটেলের দিকে। ঘড়িতে দেখলাম একটু সময় আছে পরের গন্ত্যব্যে যাবার আগে। তার ওপর আমি পুরো ভিজে গেছি, ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীত করছে খুব। ছাতাটা হোটেলের রুমে আছে - সেটাও নিতে হবে। এই সব কারণে একবার হোটেলে ঢুঁ মারব ঠিক করলাম। এই সময় বৃষ্টি টা আরও জোরে এল, ক্যামেরা আর নিজেকে বাঁচানোর জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। এটা একটা খোলা জায়গা, তিন দিকে বাড়ি দিয়ে ঘেরা, আর রাস্তায় অনেক ছাতা ওলা টেবিল পাতা। সেই রকমই একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণ। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম এটা University Paris-Sorbonne এর ক্যাফেটেরিয়া। বৃষ্টিটা একটু ধরলে দৌড়লাম হোটেলের দিকে। হোটেলে পৌঁছে ভেজা জামাটা পাল্টে, এক কাপ কফি খেয়ে আবার বেরলাম। নদীর পারে এসে ব্রিজ পেরিয়ে সকালে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলাম, সেই রাস্তাটা আবার ধরলাম। এই রাস্তাটা নদীর পার দিয়ে দিয়ে চলেছে, যেতে যেতে সকালে যে অবধি এসেছিলাম, সেই জায়গাটাও পেরিয়ে গেলাম। ম্যাপে দেখাচ্ছে এই রাস্তার নাম Quai de la Megisserie, এটা আমি জানি কারণ সকালে এখানে আমি এসেছি, Pont Neuf ব্রিজ অবধি। এই ব্রিজ টা ছাড়িয়ে আরও মিনিট ২০ হাঁটার পর, রাস্তাটার নাম বদলে হল Quai Francois Mitterrand। বাঁদিকে নদী যেমন ছিল, তেমনই আছে, কিন্তু ডানদিকে এতক্ষণ ধরে থাকা ব্যস্ত শহর আর দেখা যাচ্ছে না, বদলে পুরনো দিনের উঁচু উঁচু বাড়ি, তাদের চারপাশে অনেকটা করে খোলা জায়গা। আরও একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে, ম্যাপে যার নাম Pont Des Arts। আরও একটু এগুতেই রাস্তার দুটো শাখা বেরিয়েছে – একটা বাঁদিকে ব্রিজ হয়ে নদী পেরিয়েছে, যার নাম Pont du Carrousel, আর ডানদিকের শাখাটা একটা প্রকাণ্ড গেটের নীচে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। সিগন্যাল পেরিয়ে ওই ডানদিকের রাস্তাটা ধরে গেটের নীচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি একটা খোলা জায়গায় এসে পড়েছি। রাস্তাটা এই খোলা জায়গাটাকে দু ভাগে ভেঙ্গে সোজা উল্টো দিকের আর একটা গেটের নীচ দিয়ে বাইরে চলে গেছে। রাস্তার বাঁদিকে দূরে গাছের সারি, সাজানো বাগানের মতো দেখতে লাগছে এখান থেকে। আমি জানি ওটা Tuileries Garden। আর ডানদিকে সেই বিখ্যাত ল্যুভর। ঘড়িতে দেখলাম বেজেছে সাড়ে ১০ টা, তার মানে আরও দেড় ঘণ্টার আগে ল্যুভরের দিকে গিয়ে লাভ নেই, তাই বাঁদিকের বাগানের দিকেই চললাম।

রাস্তা পেরিয়ে, একটা গেটের তলা দিয়ে যখন বাগানে ঢুকলাম, তখন বুঝতে পারলাম কেন এটাকে প্যারিসের সব থেকে বড় বাগান বলে চিহ্নিত করা হয়। বালি আর কাঁকর মেশানো একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে বাগানের মাঝ বরাবর। রাস্তার দু পাশে বিখ্যাত স্তপতিদের হাতে তৈরি মূর্তির সারি, ডান দিকে প্রকাণ্ড এক নাগরদোলা যেটা গরমের সময় এখানে যে মেলা হয় তার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই নাগরদোলার ওপর থেকে প্যারিস শহর কে আরও সুন্দর দেখায়। রাস্তাটা একটা জলাশয় কে গোল করে পাক খেয়ে আবার সোজা হয়ে চলতে শুরু করেছে। এই জলাশয়ের চারপাশে সবুজ রঙের অনেক চেয়ার পাতা, যার সব কটাই এই বৃষ্টিতে খালি। আরও কিছু দূর হেঁটে গেলে রাস্তার দুপাশে সঙ্গী হয় গাছের সারি, ভাবতে ভালো লাগছিল যখন বসন্তে এদের গায়ে রঙ লাগবে, তখন না জানি এদের আরও কত সুন্দর লাগবে। রাস্তাটা শেষ হয়েছে আরও একটা জলাশয়ে এসে। আসার আগে পরেছিলাম, যদি হাতে সময় কম থাকে পুরো প্যারিস দেখার, তাহলে এই বাগানে এই জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাও। সামনে Place de la Concorde র মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো স্মারক স্তম্ভ, পেছনে ল্যুভর, বাঁ দিকে সেইন নদীর ওপারে Orsay Museum আর ডান দিকে Tuileries Palace। আশ্চর্য নয় যে UNESCO এই জায়গাটাকে World Heritage Site এর তকমা দিয়েছে। ছবি তুলে আর মূর্তির তলায় লেখা গুলো পরতে পরতে কাটিয়ে দিলাম ঘণ্টা খানেক, এবার পেছনে যাবার পালা।

আরও লেখা

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন ল্যুভরের সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখনও ১৫ মিনিট বাকি ১২ টা বাজতে। মাঝখানের ওই বিখ্যাত কাঁচের পিরামিড, যা আজ প্যারিসের নামের সাথেই সমার্থক, তাকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে অভিজাত প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। এক ঝলক দেখলে মনে হয়, যেন এক রাজকন্যা তার দু হাত দিয়ে আগলে রেখেছে কোলের ওপর রাখা তার খেলনা কাঁচের পিরামিডটাকে। রাজকন্যাকে লোকে চেনে Cour Carrée নামে, আর ওই দুই হাতের বাঁ দিকের টা Richelieu Wing আর ডানদিকে Denon Wing। আর ওই যে তার কোল যেখানে তার খেলনা পিরামিডটা রাখা, সেই চত্বরের নাম Cour Napoléon। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে থাকা ওই খেলনা পিরামিড যেন গল্পে পড়া টাইম মেশিন, বর্তমান থেকে অতীতে যাবার জন্য বানানো এক মাধ্যম। ভাবতেও অবাক লাগে, দ্বাদশ শতাব্দীর এই রাজপ্রাসাদ কত উত্থান-পতন, কত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কি অসীম ধৈর্যে নিজের মধ্যে সযত্নে আগলে রেখেছে মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের গল্প সে তোমাকেও শোনাতে চায়, যুগ যুগ ধরে এই কাজ করেও সে ক্লান্ত নয়। পৃথিবীর সব প্রান্তের সব ইতিহাসের রক্ষকদের সে রানী, আজও সে পারে প্রতিদিন কত লক্ষ লোকের মনে বিস্ময় জাগাতে। ওই পিরামিড তার সেই গোপন কুঠিতে ঢোকার দরজা, যার আশেপাশে এই দুর্যোগেও কৌতুহলি জনস্রোত বুঝিয়ে দেয় তার আকর্ষণের ক্ষমতা। সেই আকর্ষণে আমিও উপস্থিত হলাম তার দরজায়, গিয়ে দেখি ছাতা মাথায় বা রেনকোট পরা অসংখ্য ট্যুরিস্ট চারপাশে। লম্বা লাইন পরেছে এই বৃষ্টিতেও টিকিট কাটার। কি ভাগ্যিস, আমি অনলাইন টিকিটটা কেটে এনেছিলাম। আমাদের মতো ট্যুরিস্ট দের জন্য আলাদা লাইন, কিন্তু সেটাও লম্বা, আর সেই লাইনের আশেপাশে একটু ঘোরাঘুরি করে বুঝতে পারলাম টিকিটে যে সময় লেখা আছে, তার আগে ঢুকতে দেবে না। বৃষ্টিতে ভিজে, হেঁটে, তখন মনে হচ্ছে কখন ওই পিরামিডের মধ্যে ঢুকতে পারবো, তাহলে অন্তত বৃষ্টিটা থেকে বাঁচব। কিন্তু উপায় নেই, বাধ্য হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেরাতে লাগলাম। পৃথিবীর সব দেশের, সব ভাষার মানুষ এখানে বোধ হয় আজ জমা হয়েছে, যদিও আমি জানি এ জিনিস রোজই এখানে ঘটে, বরং আজ কিছু কম হলে আশ্চর্য হবার নেই। অবশেষে নির্দিষ্ট সময়ে, মোবাইলের ই-টিকিট পিরামিডের সামনে দাঁড়ানো সিকিইরুটি গার্ড কে দেখিয়ে, নিজের শরীরের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়ে, তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলল। ঘড়িতে তখন ঠিক ১২টা।

আসার আগেই জানতাম এই বিশাল বড় আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখতে পারবো না এই অল্প সময়ে। ভালো ভাবে দেখতে হলে একটা দিন পুরো লাগবে। তাই মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট থেকে একটু পড়াশুনো করে একটা রুট ঠিক করে রেখেছিলাম। এরকম রুট কে বলে Thematic trail। আমি যে ট্রেল টা ধরে হাঁটা শুরু করলাম সেটার নাম The Da Vinci Code, Between Fiction and Fact। Dan Brown এর লেখা The Da Vinci Code আমার খুব প্রিয় একটা উপন্যাস। এই ট্রেলটা ডিজাইন করা সেই উপন্যাসের গল্প কে ভিত্তি করে, যে উপন্যাসের মূল ধারণা দেবীর আরাধনা নিয়ে আর কিভাবে খ্রিস্টান ধর্ম তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল নারী শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে। এই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে একঘেয়ে করবো না। শুধু এটুকু লিখলেই যথেষ্ট হবে যে আর্টের কিছু না বোঝা এই আমিও অবাক হয়েছিলাম এই মিউজিয়ামের সম্পদের প্রাচুর্যে, আর্ট গ্যালারির গোলোক ধাঁধায় পথ হারিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার। এর যাত্রা শুরু পিরামিডের নীচের হল ঘর থেকে, যার নাম The Hall Napoléon। সেই হলে পৌঁছে দেখি ট্যুরিস্টের ভিড়ে হল একবারে গমগম করছে। সামনেই একটা ইনফর্মেশন কাউন্টার, যেখানে অনেক রকম ভাষায় স্বাগত লেখা হয়েছে, হিন্দিও চোখে পড়লো। মোবাইলের ম্যাপ খুলে রুটটা ঠিক করে হাঁটা শুরু করলাম। যে দুটো হাতের কথা আগে লিখেছি, তার মধ্যে আমি শুধু ঘুরেছিলাম Denon Wing ধরে। গ্রীক স্ট্যাচু Hera of Samos থেকে শুরু করে Paris Meridian (১৮৮৪ সালে Greenwich Mean Time বা GMT হওয়ার আগে পৃথিবীর সময় চলত এই লাইন ধরেই) দেখে এসে উপস্থিত হলাম এই মিউজিয়ামের সবথেকে পুরনো ঘরে, যার নাম The Salon Carré (হ্যাঁ, এই Salon শব্দ থেকেই আজ পৃথিবীর যে কোন এক্সজিবিশনকে Salon নামে ডাকা হয়)। এই ঘরের ছাদের দিকে তাকালে রঙ আর ছবির বৈচিত্রে মাথা ঘুরে যায়। এরপর লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে আরও অনেক নাম করা আর আমার নাম না জানা তৈলচিত্র দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম রুম নাম্বার ৭১১-১-ডেনন, যেখানে দেয়ালের এক দিকে ল্যুভরের সবথেকে বড় তৈলচিত্র The Wedding Feast of Cana আর অন্য দেয়ালে ল্যুভরের সবথেকে বিখ্যাত তৈলচিত্র Mona Lisa। লম্বা লাইন Mona Lisa র কাছে যাওয়ার। আমিও দাঁড়ালাম একটা লাইনে, ১০ মিনিট লাগল লাইনের শেষ থেকে প্রথমে যেতে। দু দিক থেকে লাইন এসে ধাক্কা খেয়েছে একটা রেলিং এ, যার ওপাশে হাত তিনেক দূরে সেই বিখ্যাত তৈলচিত্র। ছোটবেলা থেকে বইয়ের পাতায় দেখা জিনিষ এত সামনে থেকে দেখার যে কি অনুভূতি, তা আমি লিখে বোঝাতে পারবো না। ১৫০৪ সালে রেনেসাঁ যুগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকার পর থেকে যে ছবি সারা পৃথিবীর মানুষকে আকর্ষণ করে চলেছে আজও সমান ভাবে, তার এত কাছে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চ হয়। ১৯১১ সালে প্রথম চুরি হওয়ার পর থেকে, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, মস্কো, টোকিয়ো ঘুরে Mona Lisa আজ প্যারিসের অধিবাসী, অমলিন তার সেই হাসি নিয়ে যার রহস্য আজও গোটা পৃথিবীর কাছে অধরা। কাঁচের আবরণের পেছনে দাঁড়িয়ে আজ সে সাধারন মানুষের হাতের নাগালের বাইরে, সুরক্ষিত ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর বাতাসের অক্সিজেন থেকে। কল্পনা আর সত্যির মিশেলে, সময়ের মাপকাঠিতে অমর ওই হাসি আজও বোঝাতে চায় যে সে শুধুমাত্র স্রষ্টার কল্পনা নয়, বরং অনুপ্রেরণা যাকে লোকে চিনত Madonna Elisabetta Gherardini নামে। ২ মিনিটের বেশী এই সান্নিধ্য উপভোগ করার অনুমতি নেই, তাই বেরিয়ে পরলাম এই গ্যালারি থেকে। আরও কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে, একটা দোকান থেকে কিছু সুভেনির কিনে বেরোনোর পথ ধরলাম। এইটুকু অংশ দেখতেই দু ঘণ্টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেছে, বুঝতেই পারিনি। আর এখানে থাকা চলবে না, পরের গন্ত্যব্যে যেতে সময় লাগবে, সেখানে আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমার টিকিট বুক করা আছে। Sortie (মানে, Exit) লেখা ফলো করতে করতে কোন দিক দিয়ে যে বেরলাম, সেটা আর বোঝার চেষ্টা করিনি, বেরিয়ে দেখি প্রথম যে রাস্তা দিয়ে ঢুকেছিলাম, সেই রাস্তায় এসে পরেছি। বুঝলাম ডান দিকের ডেনন উইং থেকে বেরিয়ে এসেছি। সেই বড় গেট এর তলা দিয়ে বাইরে এসে মেন রাস্তায় উঠলাম, এবার ডান দিকে হাঁটা, পরের জায়গাটা নদীর অন্য পারে। ব্রিজ পেরবো পরে, আপাতত নদীকে বাঁদিকে রেখেই হাঁটা শুরু করলাম।

যে দিক থেকে এসে ল্যুভরে ঢুকেছিলাম Quai Francois Mitterrand রাস্তা ধরে, এবার সেই একই রাস্তা ধরে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলাম। সেইন নদীকে বাঁ দিকে রেখে রাস্তা চলেছে, কখনও তার নাম Quai des Tuileries Cours, কখনও বা La Reine আর একদম শেষে Av. De New York। এই রাস্তায় গাড়ি চলে না, এটা শুধু মাত্র পায়ে হাঁটা পথিকের জন্য, গাড়ির রাস্তা আমার ডানদিকে। জানি নদী পেরোতে হবে, পেরিয়ে এসেছি ৮ টা মতো ব্রিজ, কিন্তু এখনও নদী পেরোইনি। কারণ আমি চলেছি আইফেল টাওয়ার দেখতে, আর সেটা আমি আগে দেখবো নদীর এপার থেকে। বৃষ্টিটা থেমেছে, সাদা মেঘগুলো খুব লড়াই করছে আকাশে নিজেদের হারানো জায়গা ফিরে পেতে। কালো মেঘের দল পিছু হটছে। ১৫ মিনিট কেটে গেছে, আমি হাঁটছি, খিদেটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে, এমন সময় দূরে নদীর ওপারে চোখে পড়লো আইফেল টাওয়ারের কালো প্রতিকৃতিটা। বর্তমান পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য এই আইফেল টাওয়ার প্রথম চোখে দেখার বিবরণ টা অনেক নাটকীয় ভাবে দিতে পারতাম, কিন্তু বস্তাপচা বিশেষণ ব্যবহার না করে ঠিক যেমন টা অনুভব করেছিলাম, সোজাসাপটা সেটাই লিখছি। নীল হতে শুরু করা আকাশের ব্যাক ড্রপে, আশেপাশের সমস্ত কিছুর থেকে মাথা উঁচিয়ে থাকা আইফেল টাওয়ারের সেই ল্যান্ডস্কেপ - সত্যি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জানি সময়ে পৌঁছতে হবে টাওয়ারের পাদদেশে, তবুও এই পরিবেশে পা আপনা হতেই থেমে যায়, ক্যামেরা বের করার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। কিছু ছবি তুলে আবার এগুলাম, দূর থেকে দেখা সার্থক হবার পর কাছে যাওয়ার আর তর সইছিল না। আরও মিনিট ৪৫ হাঁটার পর, অবশেষে Pont D’lena ব্রিজ পেরিয়ে মুখোমুখি হলাম আইফেল টাওয়ারের।

ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়েছে। আমি জানতাম দুদিক দিয়ে ঢোকা যায়, কিন্তু পূর্ব দিকের রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকে। তাই ওই দিক দিয়েই ঢুকব ঠিক করে রেখেছিলাম আর সেই মতো বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগুলাম। কিছুদূর যাবার পর মোবাইলের ই-টিকিট সিক্যুরিটি গার্ড কে দেখিয়ে, নিজের শরীরের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে মানে টাওয়ারের নীচে, যেখানে চারদিক থেকে চারটে লোহার পা মাটির সাথে কোনাকুনি করে উঠে গেছে ওপরে। এই জায়গাটার নাম এসপ্ল্যানেড, এখানে প্রচুর লোকের ভিড়, তারা কেউ ছবি তুলছে, কেউ টিকিট কাটতে ব্যস্ত, অনেককে দেখলাম একসাথে বসে আড্ডাও মারতে – সত্যি আড্ডা মারার আদর্শ জায়গা বটে। প্রতি টা পায়ের নীচে টিকিট চেক করে ভেতরে যাবার লাইন, ভালো করে দেখে বুঝলাম যাদের আগে থেকে টিকিট কাটা তাদের জন্য আলাদা লাইন, সবুজ রঙে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। সেই মতো গিয়ে হাজির হলাম, তারা দেখে বলল, টিকিটে যে সময় দেওয়া আছে, তার ১৫ মিনিট আগে ঢোকা যাবে না। ঘড়িতে সময় হিসেব করে দেখলাম ১০ মিনিট কাটাতে হবে আরও। এসপ্ল্যানেড চত্বরে প্রচুর খাবার দোকান, তার মধ্যে একটাতে গিয়ে স্যান্ডউইচ, কেক আর কফি দিয়ে লাঞ্চটা সেরে নিলাম। প্রচুর পায়রা জাতীয় পাখীর ভিড় সব জায়গাটা জুড়ে, তারা মানুষ কে ভয়ই করে না। অনেক ট্যুরিস্টকে দেখলাম তারা এক হাতে খাবার নিয়ে অন্য হাতে একটা পাখীকে বসিয়ে তাকে খাওয়াচ্ছে। আমার খাবার সময় তারা এত কাছে চলে আসছিল, যে দু একবার হুস হুস করে তাড়াতেও হল। খেতে খেতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, ১৮৮৯ সালে এতো বড় ১০০০ ফুট লম্বা একটা জিনিস তৈরি হয়েছিল শুধু মাত্র লোককে দেখানোর জন্য যে ফ্রান্সের পয়সা আর কারিগরি দক্ষতা আছে পৃথিবীর সব থেকে উঁচু স্থাপত্য বানানোর। বইয়ে পড়েছি, ২০ বছর পর যখন এটাকে ভেঙ্গে ফেলার কথা বলা হয়, তখন এর স্থপতি Gustave Eiffel এর মাথায় রেডিও অ্যান্টেনা আর টেলিগ্রাফ ট্রান্সমিটার বসিয়ে দেন যেগুলো ব্যবহার হয়েছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান রেডিও কমিউনিকেশন আটকানোর কাজে। এই সব ভাবতে ভাবতে খাওয়াও শেষ আর যাবারও সময় হয়ে গেছে।

সবুজ রঙে নির্দেশ দেওয়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম মোবাইলে ই-টিকিট দেখিয়ে। ঢুকে দেখি আবার লাইন, এবার সিক্যুরিটি চেকের। একটা ছোট ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, যেখানে একদিকে শরীরের পরীক্ষা আর একদিকে সঙ্গের জিনিসপত্রের পরীক্ষা হচ্ছে। অনেকটা এয়ারপোর্টে যেরকম হয়, সে রকম। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে একটা ছোট বাড়ির মতো, যেখানে ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলে বাঁদিকে একটা লিফট, প্রচুর লোক তার সামনে অপেক্ষা করছে। আমিও ভিড়ে গেলাম সেখানে, মিনিট দুই দাঁড়ানোর পর, লিফট এল যাতে একসাথে ৩০ জন মত লোক ঢুকতে পারে। আমাদের সবাইকে নিয়ে লিফট রওনা দিল ওপরে। কয়েক সেকেন্ড পরেই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে লিফট বাইরে বেরিয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম ওপরে উঠছি আইফেল টাওয়ারের চারটে পায়ের একটা দিয়ে। নীচে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে প্যারিস শহর। প্যারিসিওরা ভালবেসে এই টাওয়ার কে ডাকে la dame de fer বলে, যার ইংরাজিতে মানে করলে দাঁড়ায় The Iron Lady। এই লেডির শরীরে তিনটে উচ্চতায় ট্যুরিস্টদের দাঁড়ানোর জায়গা (বা, অধিকার বলা ভালো) আছে – ইংরাজিতে যাদের বলে অবজারভেশন ডেক। কোমরের কাছে প্রথমটা – উচ্চতা ২০০ ফুট, পরের টা পেটের কাছে - উচ্চতা ৪০০ ফুট, আর একদম ওপরেরটা গলার কাছে - ৯০০ ফুটে। যদিও কোন কোন লিফট এক তলায় দাঁড়ায়, আমাদেরটা প্রথমে দাঁড়াল ২ তলায়। আমার টিকিট কাটা ছিল একদম ওপর তলা অবধি যাওয়ার, তাই ওপর থেকেই শুরু করবো ঠিক করে রেখেছিলাম। ২ তলায় লিফট পালটে অন্য একটা লিফট ধরতে হল, সেখানেও লম্বা লাইন। আর সেই লাইনে কোন দেশী লোক নেই – ভারতীয় ও চোখে পরল বলে মনে হল। ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে, লিফট এল, আর সেই লিফট ধরে একদম ওপরে। আকাশ পরিষ্কার এখন, রোদ উঠেছে ঝকঝকে, আর সেই আলোয় নীচে ভেজা প্যারিস শহর নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছে একটু একটু করে। এ যে কি অনুভূতি, তা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। গোল করে ঘেরা ডেকে প্রচুর ভিড়, কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত, তো কেউ শহরের ছবি তুলতে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়, চেনা পৃথিবীর পরিচিত জিনিস গুলো যেন সব কোন মন্ত্রবলে লিলিপুট হয়ে গেছে বলে মনে হয়। আশেপাশে ঘুরে বেড়ালাম আরও একটু, উঁকি মেরে দেখলাম Gustave Eiffel এর কেবিনে, যেখানে সাজানো ঘরে Eiffel আজও বসে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত Thomas Edison এর সাথে। এবার নীচে নামব, তবে লিফটে না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম দোতলায়।

আসার আগে পড়েছিলাম, দোতলার এই ডেক থেকে সব চেয়ে ভালো লাগে নীচে ছড়িয়ে থাকা প্যারিস শহরকে দেখতে। এখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম কথাটা কতদূর সত্যি। প্রথমত, এখানে লোকের ভিড় ওপরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম, তাই দাঁড়ানো যায় ভালো ভাবে। দ্বিতীয়ত, অত ওপর থেকে নীচে দেখলে মাথা ঘোরে – এখানে সেই সমস্যাটাও কম।  আর সব থেকে যেটা ভালো, শহরটাকে ওপর থেকে দেখাও হয় আর চিনতেও পারা যায় - আলাদা করা যায় বাড়ির উঁচু মাথা গুলো, আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা অনেক দ্রষ্টব্য স্থান। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে বাঁদিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি সেইন নদী, আর তার পেছনে Jardins du Trocadero বা Trocadero Gardens। ডানদিকে Champ de Mars পার্ক, যা টাওয়ারের নীচে থেকে শুরু হয়ে যতদূর চোখ যায়, ততদূর অবধি ছড়ান। পেছনে অস্তগামী বিকেলের সূর্যের অস্তিত্ব সামনে লম্বা হতে থাকা টাওয়ারের ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। প্রায় আধ ঘণ্টা মত কাটিয়ে, নীচে নামা শুরু করলাম, এবারো সিঁড়ি ভেঙ্গে। একতলায় কিছু খাবারের দোকান, সুভেনিরের দোকান দেখে (না, কিছু কিনিনি আমি ওপর থেকে কারণ বাইরে একটা দোকান দেখে এসেছিলাম আর খিদে ছিল না তখন বলে কিছু খাইনি) নীচে নামার লিফট ধরলাম। ওঠার সময় ছোট হয়ে আসা শহর আবার ফিরে পেল তার পুরনো চেহারা, আর আমিও বাইরে বেরিয়ে কিছু সুভেনির কিনে ফেরার পথ ধরলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আবার মেঘ করেছে আর সেই মেঘলোকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নীচের শহরের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছে প্যারিসের প্রিয় লৌহ মানবী।

একদিনের প্যারিস

যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেটা দিয়ে আর ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এবার নদীর উলটো পাড়ের রাস্তাটা ধরে ফেরা শুরু করলাম। এই রাস্তাটার নাম কখনও Quai Branly, কখনও বা Quai d’Orsay, আবার কখনও Quai Anatoly France। ইংরাজিতে Quai শব্দের মানে ডক, নদীর পারে বলে সব রাস্তার নামের আগে বোধ হয় ডক জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই রাস্তার ডান দিকে পরল বেশ কয়েকটা মিউজিয়াম, হোটেল, চার্চ। আরও বেশ কিছুদূর হাঁটার পর দেখতে পেলাম Orsay মিউজিয়াম, যার উল্টো দিকে সেই Tuileries বাগান, বুঝলাম অর্ধেক রাস্তা আসা গেছে। দ্রুত সন্ধ্যে নামছে, আকাশের নীল কালো মেঘে এবার দেখলাম লালচে হলুদ রঙ লেগেছে। নদীর পাশের রাস্তায় পাঁচিলের গায়ে কিছুদূর অন্তর অনেক সবুজ বাক্স দেখেছিলাম যাবার সময়, দেখতে অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় অনেক বাড়িতে যে রকম ডালা দেওয়া ডেস্ক থাকতো বা অনেক ব্যবসায়ীর গদিতে দেখা যেত, যার ওপর রেখে লেখালেখি করা হত আর ডালাটা খুলে তার ভেতর বই খাতা, পেন পেন্সিল রাখা হত, অনেকটা সেরকম। এগুলো শুধু আকারে বড়। এখন ফেরার সময় দেখি সেগুলো বইয়ের দোকান, বেশ কিছু খুলেছে। তার মধ্যে একটার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, সেটা পুরনো বই আর রেকর্ডে ঠাসা। নদীর দু পারেই এই রকম বইয়ের দোকান আছে, বলা হয় সেইন নদী নাকি পৃথিবীর সব থেকে পুরনো বইয়ের বাজারকে দু ভাগে ভেঙ্গে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। এই সব দেখতে দেখতে যখন সূর্যদেব আজকের মত কাজ শেষ করে পাটে বসলেন, তখন মোবাইলের ম্যাপে দেখলাম আমি হাঁটছি Quai Malaquais ধরে, যেখান থেকে এবার আমাকে ডান দিকের Rue Bonaparte বলে রাস্তাটা ধরতে হবে আমার পরের গন্তব্যে যেতে। কিছুদূর এগুতেই বাঁদিকে পরল দোকানটা যার নাম Ladurée। এই দোকানে আসার উদ্দ্যেশ্য macaron টেস্ট করা। macaron হল একটা বিস্কুট স্যান্ডউইচ যেটা তৈরি হয় ডিমের সাদা অংশ, চিনি আর বাদামের ময়দা দিয়ে। ভেতরের পুরটা থাকে কখনও ক্রিম, কখনও জ্যাম। রঙ্গিন এই খাবার প্যারিসের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্যারিস শহরে Ladurée র অনেক ব্রাঞ্চ আছে, এটা সবথেকে পুরনো। দোকান টা খুব বড় নয়, কাউন্টারে হরেক রকম macaron থরে থরে সাজানো। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, খুব বেশী হলে তিন দিনের বেশী এই জিনিষ রাখা যাবে না, খেয়ে ফেলতে হবে। তাই বাড়ির জন্য নিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা পরিত্যাগ করতে হল। নিজের জন্যই দু তিন রকমের macaron কিনে হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। হোটেলে গিয়েই টেস্ট করবো।

হোটেলে ফিরে কিন্তু একটার বেশী খাওয়া হল না। যখন হোটেলে ঢুকেছি তখন বাজে সন্ধ্যে সাড়ে ৭ টা। সারাদিনের ক্লান্তিতে পা দুটো আর শরীর ভেঙ্গে পরতে চাইছে তখন। হাত মুখ ধুয়ে পর পর দু কাপ কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হলাম। তারপর মনে পরল আরও একটা জায়গায় যাবার আছে আজকে, রাত ৯ টায় এপয়েন্টমেন্ট। কি করব ভাবতে ভাবতে বেরিয়েই পরলাম। যেটুকু গরম হয়েছিলাম, বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর কনকনে শীত সবটুকু শুষে নিল। ম্যাপ দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা ধরে নদীর দিকে যাওয়া, সেটা দিয়ে একটু গেলেই একটা চার মাথার মোড়, সেখান থেকে বাঁদিকে আরও মিনিট দশেক মত হেঁটে গুনে গুনে পাঁচ নম্বর ডান দিকের রাস্তাটা ধরে ঢুকলাম। একটু এগুতেই ডান হাতে পরল Le Procope, সেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহ্যবাহি রেস্তোরাঁ। ঢুকে সামনেই রিসেপশান, সেখানে গিয়ে নিজের নাম বলতেই তারা কনফার্ম করল যে আমার নামে বুকিং আছে। এক মহিলা এগিয়ে এসে আমার জ্যাকেটটা চাইলেন। সিনেমায় দেখেছি এরকম অনেকবার, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই প্রথম, তাই একটু কিন্তু কিন্তু করে নাই বললাম। তারা নিয়ে গিয়ে বসাল ভেতরে একটা টেবিলে। আমার পাশের টেবিলে এক আমেরিকান পরিবার – বাবা, মা, মেয়ে। ভালো করে গুছিয়ে বসে চারপাশে তাকালাম, সব দিকে প্রাচীনত্বকে ধরে রাখার আধুনিক চেষ্টার ছাপ স্পষ্ট। কোন কোন বিখ্যাত লোক জন এখানে এসেছেন, তারা কোথায় বসেছেন, কি শিল্প সৃষ্টি হয়েছে এই রেস্তোরাঁর টেবিল গুলোতে, তার বিশদ বিবরণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও তিন চারজন পুরুষ-মহিলা – সবারই পোশাক পরিচ্ছদে, আচার বিচারে আভিজাত্যের ছাপ। তারা খাচ্ছে, গল্প করছে, এই সব দেখতে দেখতে একজন ম্যানেজার গোছের লোক এগিয়ে এলেন আমার টেবিলের দিকে, নিশ্চয়ই অর্ডার নিতে। দুটো মেনু কার্ড – প্রথমটা পানীয়ের, আর পরেরটা খাবারের। আমি প্রথম টা থেকে অর্ডার করলাম Louis Roederer শ্যাম্পেন, দু শতকের ও বেশী পুরনো এই কোম্পানির নাম দেশে থাকতে শুনেছিলাম বললে বাড়িয়ে বলা হবে, কিন্তু এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই পড়েছিলাম। সেই শ্যাম্পেন নিলাম ১০ মিলি. র পরিমাণে, ফ্লেভার রোজ গোল্ড। আর মেন ডিশে অর্ডার করলাম শুরুতে Scottish smoked salmon, ঐতিহাসিক মেনু Braised beef cheek with Parmesan macaroni আর শেষে Pear crumble আইসক্রিম। খাবার ডেলিভারির মেয়ে আলাদা, যিনি অর্ডার নিয়েছিলেন তিনি আবার এলেন শেষে, বিল নিয়ে। সব মিলিয়ে খরচা হয়ে গেলো প্রায় ৭৫ ইউরো মতো। বিল মিটিয়ে বাইরে এসে ভাবলাম, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচা করে কেমন খেলাম? Salmon মাছের প্রিপারেশনটা বাদ দিলে বাকি সব কটাই খুব ভালো ছিল। তারপরই মনে হল, নতুন দেশে নতুন খাবার পুরনো এক রেস্তোরাঁয় বসে - এই অভিজ্ঞতাটা শুধুমাত্র টাকা দিয়ে হয়তো বিচার করাটা ঠিক হচ্ছে না। আবার কবে আসবো বা আদৌ আসবো কিনা, জানি না। ভবিষ্যৎ যেখানে অনিশ্চিত, তখন বর্তমানের দাম সত্যি কতটা থাকে? এই সব ভাবতে ভাবতে আর ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটাকে যখন টেনে এনে হোটেলে ঢোকালাম, তখন প্রায় ১০ টা বাজে। ঘরে ফিরে সোজা বিছানায়।

আরও লেখা

Paris 5

পরের দিন সকালে উঠে ট্রেন ধরে সন্মেলনের জায়গায় যাওয়া আর বাকি ৪ টে দিন সেখানে কাটানো – এই নিয়ে বিস্তারিত লিখে পাতা বাড়াবো না। শুধু এই টুকুই লিখি – এই কটা দিনে আমার এক নতুন কাজের পরিবেশে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের বিজ্ঞানীদের মাঝে একা এশিয়ান হিসেবে নিজের উপস্থিতি নিজেকেই নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছিল অনেকটাই। এতদিনের কূপমণ্ডূক ভাবটা দেশের বাইরে যবে পা রেখেছি, তবে থেকেই কমতে শুরু করেছিল, আর এই কদিনে সেটা এক ধাক্কায় আরও অনেকটা কমে গিয়েছিল। দিন থেকে রাত, আবার পরের দিন – কি ভাবে যে সময় কেটেছে, সেটা আজও ভালো করে বুঝিনি। এক দুবার যে মনে হয়নি, যে আর ভালো লাগছে না, টা নয়; কিন্তু সেই ভাবনাটাও মনে জাঁকিয়ে বসার সময়টুকুও পায়নি, ফলে মন খারাপগুলোও কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

সন্মেলনের শেষ দিন মানে ১৫ তারিখ সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। দুপুরবেলা সন্মেলন শেষ হবার পর আয়োজকরা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন স্টেশন অবধি যাবার জন্য। সবার সাথে আমিও স্টেশন অবধি এলাম, কিন্তু বাকি সবার মতো ট্রেন না ধরে স্টেশন এর কাছেই বুক করা হোমস্টেতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একজন বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী সেটার মালিক, নাম Didier এবং Brigitte। কিন্তু চেক-ইন বিকেল ৫ টার আগে করা যাবে না। তাও একবার অনুরোধ করেছিলাম যখন বুকিংটা কনফার্ম করতে ইমেইল করেছিলাম, ওনারা রাজিও হয়েছিলেন। ভাগ্যিস, না হলে এই বৃষ্টিতে সকাল ১২ টা থেকে বিকেল ৫ টা অবধি কি করতাম, জানি না। যাই হোক, Brigitte আমাকে অভ্যর্থনা করল ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে। সদর দরজার পরেই একটা প্যাসেজ, দু দিকে ঘর। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে জুতো খুলতে হল, জুতো পরে বাড়ির ভেতর যাবার নিয়ম নেই। এই জিনিস ইউরোপের কোন বাড়িতে দেখবো, ভাবিনি। জুতো হাতে, লাগেজ আর এক হাতে নিয়ে ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে আড়াই তলায় উঠে এলাম। সিঁড়ি টা যেখানে শেষ হয়েছে, যাকে ইংরাজিতে ল্যান্ডিং বলে, তার সামনে একটা বাথরুম, দুদিকে দুটো ঘর – আমাকে নিয়ে Brigitte দাঁড়ালো ডান দিকের ঘরটার সামনে। কাঠের দরজার বাইরে একটা নেমপ্লেটে আমার নাম লেখা, চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বুঝলাম এটা বাড়ির চিলেকোঠা। কিন্তু চিলেকোঠা শুনলেই যে ছবিটা মনে আসে, এটা একদমই সেটার সাথে মেলে না। ঘরের মাঝখানে একটা খাট, দু পাশে টেবিল। দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে একটা বড় ড্রেসিং টেবিল, তার পাশে জামা কাপড় রাখার আলনা। একটা ছোট টেবিলে কাঁচের জারে অনেক টফি রাখা। দরজার সামনা সামনি উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা জানালা, আর তার নীচে হিটার। ঘরের ছাদ টা সোজা নয়, দরজার দিক থেকে ঢালু হয়ে জানালার ওপরে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমাকে সব দেখিয়ে দিয়ে Brigitte চলে গেলো, আমিও ভেজা জামা কাপড় ছেড়ে এক কাপ কফি নিয়ে ভাবতে বসলাম – বিকেলে কি করবো। মোবাইল ে দেখাচ্ছে, বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই, তাপমাত্রাও নামবে। কফি খেতে খেতে মনে পড়ল, এই ঘরে ধূমপান করা যাবে না। নীচে গেলাম, সেই জুতো হাতে নিয়ে, সদর দরজা দিয়ে বাইরে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালাম, এটা ধূমপানের জায়গা বোঝাই যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক করে ফেললাম কি করবো। বাইরে তখন বৃষ্টির জল সাদা হতে শুরু করেছে।   

ঘরে ফিরে জামা কাপড় পাল্টে, পিঠের ব্যাগে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। দুপুরের খাওয়া সেরেই এসেছিলাম সন্মেলনের জায়গা থেকে, রাতের টা পরে ভাবব। Brigitte কে বললাম, শহরে যাচ্ছি, ফিরতে একটু রাত হতে পারে। সে বলল, তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কর, বৃষ্টি বাড়বে, বরফ পরতে পারে, ট্রেন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঘড়িতে দেখলাম বিকেল ৩ টে, সব ঠিকঠাক হলে ৭ টার মধ্যে ফিরে আসা উচিৎ। স্টেশনে এসে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালাম। চারদিন আগে যখন এসেছিলাম, তখন ভালো করে দেখা হয়নি স্টেশনটা, এবার দেখলাম দুটো প্ল্যাটফর্ম। যেহেতু এটা এই লাইনের শেষ স্টেশন, যে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসে, সেখান থেকেই আবার উল্টো মুখে ফেরত যায়। যদি না ফিরতে চায়, তাদের জন্য পাশের প্ল্যাটফর্মটা। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। রঙ্গিন ডিসপ্লে বোর্ডটা ভালো করে দেখে বুঝলাম, এখনও ট্রেন আসতে ৮ মিনিট মত বাকি। আর কোন লোক না দেখে প্রথমটায় একটু অবাক হয়েছিলাম, পরে বুঝলাম বৃষ্টির জন্য সবাই টিকিট ঘরের সামনে ছাউনির তলায়। ২৫ টা স্টেশন পেরোতে হবে, যার মধ্যে ৬ টা স্টেশনে ট্রেন টা দাঁড়াবে না। ট্রেন এল ঠিক সময়ে, আমিও ফাঁকা একটা কোচ দেখে উঠে বাঁ দিকে জানালার ধারে বসলাম – এই দিকেই প্ল্যাটফর্মগুলো পরবে, নামগুলো দেখা দরকার, না হলে নামতে পারবো না ঠিক জায়গায়।

ট্রেন ছাড়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে বাইরে দিনের আলো নিভে এলো। কিন্তু তার আগেই আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি – যে বৃষ্টি র ফোঁটা গুলো হোটেল থেকে বেরোনোর সময় সাদা মনে হয়েছিল, সেগুলো এখন হাল্কা বরফের কুচি হয়ে হাওয়ার সাথে মিশে উড়ে বেড়াতে শুরু করেছে। নীচের কালো প্ল্যাটফর্ম রঙ পাল্টাচ্ছে। এই ভাবে চলল ঘণ্টা দেড়েক, যত ট্রেন এগুচ্ছে, ভিড় বাড়ছে। Luxembourg স্টেশন আসতে উঠে দাঁড়ালাম, নামতে হবে পরেরটায়। কিন্তু নামবো বললেই কি নামা যায়? ভিড় এত বেড়েছে যে পা ফেলে সামনে এগুনোর কোন জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে একজন লোক কে ধাক্কা মেরে, একজনের হাতের তলা দিয়ে, একজনের পা মারিয়ে অবশেষে প্লাটফর্মে নামতে পারলাম – সেই স্টেশন যেখান থেকে আমি চার দিন আগে উল্টো দিকের ট্রেন ধরেছিলাম, St Michel/Nôtre Dame। এখনকার গন্তব্য Annick Goutal পারফিউমের দোকান। প্যারিসের  ভালো পারফিউম বলতে স্থানীয় লোকেরা যে কটা জায়গার নাম বলে, এটা তাদের মধ্যে একটা। অন্যগুলো অনেক দূরে, আর এখানে যাবার রাস্তার কিছুটা আমার পরিচিত, তাই এই দোকানেই যাব ঠিক করে রেখেছিলাম।  

ট্রেনে বসেই ম্যাপটা ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম, এখন দেখলাম ঘড়িতে বিকেল ৫ টা। স্টেশন থেকে ওপরে এসে যে রাস্তা দিয়ে ল্যুভরে গিয়েছিলাম, সেই একই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ভেজা পাথুরে রাস্তায় ভয় হয় পা না হড়কে যায়, তার ওপর উল্টোদিক থেকে আসা অফিস ফেরত গাড়ি গুলোর আলো ভেজা রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে চোখে এসে পড়ছে, তাই গতিও বাড়াতে পারছি না। এর মধ্যে ছাতাটাও অবাধ্য হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, আর তার কানে এসে কুবুদ্ধি দিচ্ছে নদীর পারের লাগাম ছাড়া হাওয়ার দল। তারা আবার হাত মিলিয়েছে বৃষ্টির জোলো হাওয়ার সাথে, সব মিলিয়ে শরীরের ভেতর আসতে আসতে বাড়তে থাকা কাঁপুনিটাও জানান দিচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা ল্যুভরকে ডান পাশে রেখে এসে পড়লাম Rue de Rivoli তে, সেখান থেকে বাঁদিকে মিনিট ২০ হেঁটে, রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকের একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলাম – এটার নাম Rue de Castiglione। এই রাস্তা দিয়ে একটু এগুতেই ডান দিকে চোখে পড়ল দোকানটা। ভেতরে ঢুকে যা দেখলাম আর শুঁকলাম, কোনোদিন ভুলবো কিনা বা ভুলতে পারবো কিনা, জানি না। তিন মানুষ লম্বা একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঁচের শোকেসে থরে থরে সাজানো কাঁচের বোতলে বিভিন্ন রঙের পারফিউম, তাদের প্রত্যেকের গন্ধ আলাদা। ফেরার সময় ট্রেনে বসে গুনেছিলাম – আমি শুঁকেছিলাম প্রায় ১৮ রকমের গন্ধ, ৫ টার পর থেকে গন্ধ বিচারের ক্ষমতা কমতে কমতে ৯ টার পর থেকে লোপ পেয়েছিল। সে যাই হোক, এরই মধ্যে দুটো পছন্দ করে নিলাম – তাদের অনেক রকম নাম, অনেক রকম ভাগ – সেই সব আর লিখে কাজ নেই। দু জন মেয়ে দোকান এর দেখাশোনা করে, তাদেরকে গিফট এর কথা বলতেই তারা খুব সুন্দর করে প্যাক করে দিল। সেই ব্যাগ পিঠের ব্যাগে চালান করে দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম – আসার উদ্দ্যেশ্য সফল। ফেরার পথে মায়েদের আর বাবাদের জন্য কিছু জিনিস, আমার বসের জন্য একটা শো-পিস কিনে ফেরার ট্রেনে উঠলাম। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাড়ে ৭টা।        

হোমস্টেতে ফিরে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে যখন ঢুকছি, তখন রাত ৯টা। দরজার মাথায় একটা ঘণ্টিতে টান পরতেই সেটা মিষ্টি একটা আওয়াজ করে আমাকে স্বাগত জানালো। ফেরার সময় খাবার পাইনি কিছু, যাবার সময় যে দোকান গুলো দেখেছিলাম স্টেশনের পাশে, সেগুলো সব বন্ধ-দেখে এসেছি। ম্যাপে দেখাচ্ছে আশেপাশে দেড় কিলো মিটারের মধ্যে আর কিছু নেই। বুঝলাম উপোষ করা ছাড়া গতি নেই। শেষ আশা ছিল যদি হোমস্টেতে কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু রাত হয়ে গেছে অনেক, তাদেরকেও বিরক্ত করতে মন চাইল না। ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে, কফি বানালাম। পরে থাকা তিনটে macaron আর কাঁচের জারে রাখা টফি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা বিছানায়। মোবাইলের ওয়েদার রিপোর্ট বলছে – বাইরে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি আর তার সাথে বৃষ্টি আর বরফ।

একদিনের প্যারিস

ফেরার দিন – রবিবার (১৬ই নভেম্বর)

উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি আমার ফেরার দিনে, শুধু অদ্ভুত ভাবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এটা আলাদা তার কারণ আগে এত বার এত জায়গায় গেছি, সেখান থেকে ফেরার সময় অনুভুতিটা হতো আলাদা। হোমস্টে থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে এয়ারপোর্টে যেতে যেতে এই বৈপরিত্যটাই খোঁচা দিচ্ছিল বার বার। একবার মনে হল, বয়স হয়ে যাচ্ছে, নিজের চেনা পরিবেশ থেকে তাই বাইরে বেরোলেই মনটা ফেরত যাই - ফেরত যাই করে। আরও কয়েক বছর আগের নতুন কিছু করার, চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোনোর ইচ্ছেটা আজ ডুব মেরেছে কোথাও। তারপর মনে হল – এই জায়গাটা হয়তো আমার ভালো লাগে নি। লোককে বললে হাসবে – প্যারিস ভালো লাগে নি? ভেবে দেখলাম, এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই জোরালো হল। এর কারণটাও খুঁজে পেলাম – বড্ড একা লেগেছে এই কদিন। যে কটা জায়গায় ঘুরেছি এই শহরে, সব সময়ই মনে হয়েছে ‘চি’ টা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। ভালোবাসার শহর বলে খ্যাতি আছে শুনেছি প্যারিসের, তারই প্রভাব হয়তো। ভেবেছিলাম কাজের জায়গায় গেলে মনটা ঠিক হবে – যেরকম আগেও হয়েছে যখনই কোন সন্মেলনে গেছি। এখানে দেখলাম সেটা হল না, এখানের লোকজন খুব প্রফেশনাল, কাজের বাইরে অন্তরঙ্গতার কোন সুযোগ ঘটেনি, তাই একাকীত্বটাও জাঁকিয়ে বসেছিল। এরকম নয় যে এখান থেকে যেখানে ফিরছি, সেখানেও প্রচুর সঙ্গ পাবো, কিন্তু তাও সেটা আমার কর্মস্থল, গত দেড় বছরে যে শহরের সাথে আমার ভালোলাগাটা বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক কারণে।

যে পথ দিয়ে ছ’দিন আগে এসেছিলাম, সেই একই পথ দিয়ে এবার ঘরে ফেরা। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সব ফর্মালিটি শেষ করে আগে পেট ভরে খেলাম – বার্গার, কেক, কফি। সামনে এক বৃদ্ধ দম্পতি, এশিয়ার কোন দেশের, দেখে মনে হয় ট্যুরিস্ট। তাদের অল্পবয়সী সঙ্গীরা দূরে বসে, কিন্তু এনারা দুজন নিজের মতো করে ব্যস্ত। বসার লাউঞ্জের একদম সামনে কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে একে অপরের ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত, পেছনে অপেক্ষমান প্লেন। দেখে মনে হয়, তাদের খুব বেশী সুযোগ হয়নি আজ পর্যন্ত আকাশে ওড়ার, নীচের ওই পৃথিবীর রোজকার লড়াইতেই চলে গেছে অনেক গুলো বছর। আজ সুযোগ এসেছে, কে জানে, হয়তো প্রথমবার বিদেশ যাত্রার। তাহলে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোন এক রাতে একসাথে দেখা একটা স্বপ্নকে সত্যি করার ওই সরল বিস্ময়, ওই হাসি - এর থেকে ভালো পুরস্কার আর কিই বা হতে পারে? ভাবতে ভালো লাগে, যদি সত্যি এমনটা হয়। প্যারিসে এটাই আমার সবথেকে প্রিয় স্মৃতি, সব থেকে ভালো ফ্রেম।

দুপুর ১২ টা ২৫ এ এয়ার চায়নার প্লেন, বেজিং হয়ে যখন গুয়াংঝো নামলাম, তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ১১ টা, তারিখটা ১৭ ই নভেম্বর। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসে করে ইউনিভার্সিটি পৌঁছলাম দুপুর দেড়টা। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে ল্যাপটপে ছবিগুলো কপি করার সময় চোখে পড়ল যাবার আগে আমার করা নোট্‌স গুলোর ওপর। অনেক কিছু দেখা হল না এবারে, পরের বার সব দেখবো হাতে সময় নিয়ে। তবে আর একা নয়, এবারের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো জুড়ব পরের বার আরও ভালো করে, দুজনের হাত দিয়ে। ততদিন এগুলোই থাকুক জমানো, সময় অসময়ে পাতা উলটে পড়ে না হয় ঘুরে আসা যাবে আরও কয়েকবার।

Paris 6

আরও লেখা

শেষ
bottom of page