
একদিনের প্যারিস
এর আগে বিজ্ঞানী সন্মেলনে ঘুরে এসেছি অস্ট্রেলিয়া থেকে, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর দেখে এসেছি। সে আজ থেকে প্রায় বছর আটেকের আগের কথা। সেই লেখা আজও লিখে উঠতে পারিনি। তবু প্রতিটা মুহূর্ত আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, ফিরে যেতে পারি সেই এক সপ্তাহের সাত টা দিনে। তবে ইউরোপ এর অন্যতম প্রাচীন শহর প্যারিস এর কাছে সেই অভিজ্ঞতা যেন কোথাও ফিকে হয়ে যায়। তাই প্রথম থেকেই শুরু করি, কি ভাবে যাবার সুযোগ এল, কি ভাবেই বা পৌঁছলাম, আর কেমনই বা লাগল আমার চোখে দেখা প্রথম ইউরোপ।
সুযোগ টা এসেছিল একটা ইমেইল মারফত, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রন জানানো হয়েছে প্যারিসে, একটা সন্মেলনে যোগ দেবার জন্য। আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি, সেই বিষয়ের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হবে এই সন্মেলন। কিন্ত যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হবে কয়েক জনকে। চোখ বন্ধ করে দিলাম আবেদন করে। মাস কেটে গেলো, উত্তর আর আসে না। তারপর এল সুখবর, অক্টোবর মাসের প্রথমে। আমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছল আমার ইমেইল এ। তার মানে যাত্রা করা যেতে পারে। সেই দিন থেকে যাবার এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত কাটল সব কাগজ পত্র তৈরি করতে - ভিসা হল, টিকিটও কাটা হল, ইউনিভার্সিটি থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সারও আয়োজন হল। চিনে টাকা পরিবর্তন করে ইউরো নিলাম। ক্রেডিট কার্ড গুলো সঙ্গে নিয়ে নিলাম, বলা যায় না কোথায় কখন কাজে লেগে যায়। এই সময় বলা দরকার, উদ্যোগকারীরা অনেক সাহায্য করেছেন আমায়, যখন যে ভাবে চিঠির দরকার হয়েছে, পেয়েছি।
এর মধ্যে আমি আরও একটা কাজ করলাম। ভালো করে চোখ বোলালাম সন্মেলনের সময় সূচিতে, যেটা শুরু হচ্ছে ১২ তারিখ থেকে আর চলবে ১৫ তারিখ অবধি – মানে মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার। আমি টিকিট কেটেছি এমনভাবে যাতে আমি পৌঁছব রবিবার রাতে, আর ফিরে আসার জন্য বেরিয়ে পরবো শনিবার বিকেলে। সন্মেলনটা যেখানে হচ্ছে, সেই জায়গাটার নাম Saint-Remy-les-Chevreuses। শহরের ম্যাপ দেখে যা বুঝলাম, জায়গাটা প্যারিস শহর থেকে অনেক দূরে, প্রায় গ্রাম বলা চলে। শহরের মেট্রো ম্যাপ এ সবচেয়ে লম্বা যে রুট, তার প্রথম স্টেশন হচ্ছে এয়ারপোর্ট আর শেষ স্টেশন এই জায়গাটা। প্রায় ১ ঘণ্টার ওপর সময় লাগে এক পিঠ যেতে। আশেপাশে কিছু নেই, একটা ট্রেন স্টেশন, বাস ডিপো, কিছু অল্প দোকান নিয়ে ছোট একটা গ্রাম। তার ওপর সন্মেলন চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি, যার পর শরীর দিলেও, মন সায় দেবে না শহরে আসার। তাই যা করার, যা দেখার দেখতে হবে একদিনেই – সোমবার হতে হবে সেই দিন। মঙ্গলবার সকালে পৌছলেই হবে গ্রামে। তাই এবার ভালো করে পরিকল্পনা করতে বসলাম। একদিনে কিভাবে প্যারিস দেখা সম্ভব – কি কি দেখব, আর কি কি এবারের মত বাদ দেব।
যাবার আগের প্রস্তুতি
প্রথমে বসলাম যাতায়াত নিয়ে। যে সব ওয়েবসাইট থেকে ইনফর্মেশন পেয়েছিলাম, তার একটা লিস্ট নীচে দিয়ে রাখব, যাতে পরে কাজে লাগে। যাইহোক, আমার যাওয়া আর আসা দুটোই এয়ার চায়না তে। গুয়াংযো থেকে বেজিং হয়ে প্যারিস এর Charles De Gaulle (CDG) এয়ারপোর্ট । আরও একটা এয়ারপোর্ট আছে প্যারিস শহরে – Orly এয়ারপোর্ট। আমি পৌছব স্থানীয় সময় বিকেল ৫-৪৫ এ। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে শহরে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে সময় আর পয়সা দুই বেশি লাগবে, তাই স্থির করলাম ট্রেন এ যাব। প্যারিস শহরে ১৬ টারও বেশি লাইন আছে, ৩০০ ওরও বেশি স্টেশন। এর মধ্যে যে লাইন টা শহরের কেন্দ্রস্থল কে আশেপাশের জায়গা গুলোর (যাকে ইংরিজিতে বলা হয়, suburb) সাথে যুক্ত করে, সেই লাইন টার নাম RER। দেখে বুঝলাম RER-B লাইন এর ট্রেন ধরতে হবে আমাকে CDG থেকে আর এই লাইনের শেষ স্টেশন হচ্ছে সন্মেলনের জায়গা। ট্রেন যাবে শহরের মধ্যে দিয়ে, এই মাথা থেকে ওই মাথা – মাঝে পরবে প্যারিস শহর। শনিবার রাতে নেমে যদি আমি এই লাইনের মাঝের কোন স্টেশন এর আশেপাশে থেকে যেতে পারি, আর সেই জায়গা টা যদি শহরের মধ্যে হয়, তাহলে সুবিধা হবে। মাঝের স্টেশন গুলো দেখে ঠিক করলাম থাকা যেতে পারে St Michel/Nôtre Dame এর আশেপাশে। প্রচুর দেখার জিনিষ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, সোমবার টা ভালো ভাবে কাটানো যাবে। মঙ্গলবার সকালে বেরিয়ে আবার ওই স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরে সোজা চলে যাব সন্মেলনের জায়গায়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ – এবার দেখতে হবে থাকার জায়গা। উদ্যক্তরা থাকার ব্যবস্থা করবেন শুধুমাত্র সন্মেলনের দিন গুলোর জন্যে (মানে ১২ থেকে ১৫) – তাই বাকি দিনগুলো আমাকে ভাবতে হবে। ১০-১২ তারিখ এর জন্য স্থির করলাম মোটামুটি ভালো একটা হোটেল দেখব, আর শেষ দিন টা শহরে না ফিরে, সন্মেলন শেষ হবার পর ওই গ্রামেই থেকে যাব কোথাও। সেই মত, হোটেল খুঁজতে বসলাম। অনেক টালবাহানা আর হিসেবপত্তর করার পর, প্রথমে বুক করলাম যে হোটেল টা তার নাম - Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés (ঠিকানা-14 Rue de la Sorbonne, Paris, France, 75005)। স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ। আর সকালের ব্রেকফাস্ট টা complementary। শেষের দিনটা ঠিক করলাম থাকব একটা home stay তে – নাম chambre d'hôte (ঠিকানা- 4 rue Henri Janin, Saint-Rémy-lès-Chevreuse, France, 78470)।
এবার আসল কাজ – কি ভাবে একদিনে প্যারিস দেখা যায়। হাতে আছে ১১ তারিখ টা শুধু। পড়াশুনো করতে শুরু করলাম অবসর সময়ে। প্রচুর আর্টিকেল আছে ইন্টারনেট এ, সেগুলো ভালো ভাবে পরে একটা ম্যাপ বানালাম। মোবাইল এর ম্যাপ খুলে জায়গাগুলো মার্ক করলাম, আর কিভাবে সেগুলো কভার করা যায়, তার একটা প্ল্যান করলাম। শেষে বুঝলাম, দুটো জায়গা আছে যেখানে ভিড় হবে প্রচুর আর টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। টিকিটের জন্য লাইন দেওয়া মানে সব সময় ওখানেই চলে যাওয়া। অনলাইন টিকিট কাটা যায় যেখানে দিন আর সময় নির্দিষ্ট করে বলতে হবে। সেই মতো ১১ তারিখের সকালে ১২ টার সময় বুক করলাম ল্যুভর মিউজিয়াম আর দুপুর ৩ টের সময় আইফেল টাওয়ার। ঠিক করলাম হোটেল থেকে সকালে বেরিয়ে ল্যুভর যাবার পথে কিছু জিনিষ দেখবো, ল্যুভর থেকে আইফেল যাবার পথে কিছু, আর তারপরেও যদি শরীর দেয়, তাহলে ফেরার পথে কিছু। যেদিন পৌঁছব, সেদিন রাতে কিছু খেয়ে শুয়ে পরলেই হবে, কিন্তু ১১ তারিখ টা রাতে খাবার জন্য প্যারিস এর অন্যতম পুরনো একটা রেস্তোরায় টেবিল বুক করলাম। নাম – Le Procope, স্থাপিত ১৬৮৬ সালে। তাহলে যাওয়া ঠিক, থাকা ঠিক, খাওয়ার ব্যবস্থাও ঠিক, ঘোরাও মোটামুটি নিশ্চিত। এবার গিয়ে পরতে পারলেই হোল।

একদিনের প্যারিস
যাবার দিন – রবিবার (১০ই নভেম্বর)
এই করতে করতে এসে পরল যাবার দিন। দিনটা ১০ই নভেম্বর। সকালে ৮ টা ১০ এর ফ্লাইট গুয়াংযো থেকে, প্রথমে যাওয়া বেজিং, সেখান থেকে প্যারিস। আমার সঙ্গের লাগেজ বলতে একটা পিঠের ব্যাগ যাতে আমার ক্যামেরা আছে, একটা ল্যাপটপ ব্যাগ যাতে ল্যাপটপের সাথে পাসপোর্ট আছে, আর একটা ট্রলি যাতে আমি ভরেছি গরম জামা শুধু। যখন দেখেছি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে ৭-১০ ডিগ্রির ভেতরে, এবং আগামী দিনগুলোতে সেটা আরও কমবে, তখন তড়িঘড়ি গিয়ে একটা জ্যাকেট কিনে এনেছি। ইউনিভার্সিটি এর সামনে থেকে এয়ারপোর্ট এর বাস ছাড়ে আমাদের, সকালের প্রথম বাসে চেপে বসলাম, তখন ঘড়িতে বেজেছে ৫ টা। শহর তখনও উঠিউঠি করছে, রাস্তায় কিছু মালবোঝাই লরি শহরের খাদ্যের আয়োজনে ব্যস্ত। একজন স্টুডেন্ট এসেছিল আমাকে বাসে তুলে দিতে, দরকার ছিল না, কিন্তু আমার বসের হুকুম সেই বা অমান্য করে কি করে। তাকে টাটা করে বাস চলল এয়ারপোর্ট এর দিকে, গুটিকয়েক যাত্রীকে সঙ্গী করে।
নির্দিষ্ট সময়ে প্লেন ছাড়ল, ১১ টায় বেজিং পৌঁছে ট্রান্সিট, হাতে সময় আড়াই ঘণ্টা মতো। তাড়াহুড়ো করে পরের প্লেন এর চেক ইন সারলাম, মাথায় তখন খালি ঘুরছে শেষ বার চায়না তে প্লেন মিস করার কথা, এই একই কারনে। যাই হোক, সময় মতো সব হলও, প্যারিস এর প্লেন ছাড়ল ঘড়িতে তখন দুপুর ১ টা বেজে ৩০ মিনিট। সামনে লম্বা যাত্রাপথ – প্রায় ৫০০০ মাইল পথ পাড়ি দেবে এই এয়ারবাস ১১ ঘণ্টায়। তাই সিট নিয়েছিলাম চলাচল করার করিডরের পাশে, সামনের সিট এর সারি ফাঁকা আর তার সামনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা। ৩ জনের সিটে আমার পাশে দুই মহিলা যাত্রী – দুজনেই আমার সমবয়সী এবং কথা থেকে বোঝা যায়, তারা ফ্রান্স এরই অধিবাসী। ইউরোপিয়ান চরিত্রের নমুনা মিলল যাত্রাপথেই। রোদ এর পথ আটকে ঘুমোচ্ছিল আমার দুই সহযাত্রী, আর যাত্রা পথের একঘেয়েমি দূর করতে পেছনের যাত্রী দের কেউ কেউ উঠে আসছিলেন সামনের খোলা জায়গাটায়। এদেরই একজন আমাদের সামনের ফাঁকা সিটে বসে জানালা টা খুলে দিচ্ছিলেন, আর যার ফলে সুযোগ পেয়ে বাইরের সূর্য ঢুকে পড়ছিল ভেতরে। ঘুমের ব্যাঘাত হতে আমার পাশের সহযাত্রীটি দুবার বিরক্তি সূচক শব্দ করলেন, তিন বারের বার আর থাকতে না পেরে জানালাটাই ধরে বেশ জোরের সাথেই দিলেন নামিয়ে। ভাষা যেখানে মত প্রকাশের অন্যতম অন্তরায়, সেখানে এই আচরণ হয়তো বা সঙ্গত, কিন্তু ভাবলাম – আমরা পারতাম কি প্রথমেই এই আচরণ করতে নাকি বোঝানোর চেষ্টাতে কিছুটা সময় খরচ করতাম আগে? যেখানে আমি যাচ্ছি, এই নমুনা কি সেই সমগ্র জাতির ব্যবহারের প্রতিনিধি? অপেক্ষা তো আর কয়েক ঘণ্টার, তারপর দেখবো। ততক্ষণ আমি মন দিলাম খাবারে – স্বীকার করতেই হবে এয়ার চায়না খেতে দেয় ভালই, আর অনেকবার। ওঠার পর লাঞ্চ, তারপর স্ন্যাক্স, আবার নামার আগে ডিনার। আর এর মাঝে ড্রিংক, যাতে নরম থেকে গরম সব রকম পানীয়ই থাকে। এই সব খেয়েও আমি উঠে গিয়ে এয়ারহোস্ট দের কেবিন থেকে চার বার কফি খেয়ে এসেছি।
একঘেয়ে যাত্রাও একসময় শেষ হল, ঘড়িতে দেখি রাত ১ টা। সময়ের পার্থক্যটা আগে থেকেই হিসেব করা ছিল, একদিন পিছিয়ে পরেছি, এখন এখানে বেজেছে বিকেল ৬ টা। প্লেন থেকে বেরিয়ে লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে লেগে গেলো আরও ঘণ্টা খানেক। এরপর ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতে লাগল আরও আধঘণ্টা মতো। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ২ থেকে স্বয়ংক্রিয় ট্রেনে চেপে বিনামুল্যে চলে আসা যায় টার্মিনাল ৩ যেখান থেকে RER-B লাইন এর ট্রেন ছাড়ে। টিকিট কাটতে লাগল ১০ ইউরো মতো, হাতে টিকিট নিয়ে কলকাতা মেট্রোর মতো মেশিনে ঢুকিয়ে ঘোরানো গেট পেরিয়ে পা রাখলাম ট্রেন স্টেশনে। স্টেশন টা নিচে, তার দুটো প্ল্যাটফর্ম – একটাতে ট্রেন শহরে যায়, আর একটা দিয়ে এয়ারপোর্টে আসে। স্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ডে সময় গুলো দেখে বুঝলাম এখানে দুরকমের ট্রেন আছে – একটা হাইস্পিড যেটা সব স্টেশনে থামবে না, আর একটা রেগুলার। আমার গন্ত্যব্যে দুরকম ট্রেনই যাবে, তাই অপেক্ষা করলাম প্রথম রেগুলার ট্রেন টা ছেড়ে দিয়ে। মাঝের সময়টা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে কাটাতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়লো। ওপরে এয়ারপোর্ট চত্বর যেন আধুনিক প্যারিসের প্রতিনিধি আর নিচে আধো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা ট্রেন স্টেশন, লাইনের পাশের নোনা ধরা দেওয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে – যেন প্রথম পরিচয় করায় শহরের আত্মার সাথে, মনে করিয়ে দেয় আমরা এসেছি সেই শহরে যা আজও তার প্রাচীনত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত। ওপরের শহরের আলোকজ্জ্বল আধুনিকতার নিচে একটুকরো পুরনোকে বুকে জড়িয়ে সে আজও সাখ্য দেয় পুরনো প্যারিসের যার জন্ম সেই ২৫৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে PARISSI নামক এক উপজাতির হাত ধরে।
ট্রেন এলো যথাসময়ে, আর আমিও আমার জিনিসপত্র নিয়ে চেপে বসলাম তাতে। ঘড়িতে তখন প্রায় ৮ টা। স্টেশনের পর স্টেশন ছাড়িয়ে চললাম। ট্রেনে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মিলিয়ে যাত্রী খুব অল্প নয়, লোক উঠছে-নামছে, আমি মোবাইলের স্ক্রীনে নজর রেখেছি, জানি কখন আমায় নামতে হবে। Gare du Nord (যেখান থেকে Eurostar ট্রেন লন্ডন আর প্যারিস কে যুক্ত করে) আর Chatelet Les Halles স্টেশন ছাড়িয়ে এলো St Michel-Nôtre Dame স্টেশন। নেমে পরলাম, নির্দেশিকা অনুসরণ করে বেরুলাম Saint-Germain Boulevard এ, মাটির তলা দিয়ে লম্বা পথ পেরিয়ে আসতে লাগল প্রায় মিনিট পাঁচেক। আর বেরিয়েই বুঝতে পারলাম ঠাণ্ডাটা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর কেঁপে উঠল, গায়ের পুলওভার টা গলা অবধি টেনে ওপরে এসে দাঁড়ালাম। যেখানে বেরুলাম, সেই জায়গাটা একটা চৌমাথা। ম্যাপটা মোটামুটি মাথায় ছিল, সেই মতো দিক আন্দাজ করে হাঁটা শুরু করলাম। চৌমাথা থেকে বাঁদিকে Saint-Germain Boulevard ধরে মিনিট পাঁচেক মতো হেঁটে আবার বাঁদিকে বেঁকে কিছুটা গিয়ে একটা ছোট রাস্তা ডানদিকে ঢুকে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে ডান হাতে পড়ল হোটেলটা - Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés। হোটেলের সামনের রাস্তায় বোধহয় গাড়ির পারকিং, সরু রাস্তার বাঁদিকে সোজা উঠে গেছে ৫ তলা বাড়ি যার বিস্তৃতি রাস্তার এই মাথা থেকে ওই মাথা। ম্যাপে দেখলাম সেটা University Paris-Sorbonne। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ৯ টা।
হোটেলের পেমেন্ট করাই ছিল, বাকি ফর্মালিটি সেরে ঘরে ঢুকে পরলাম। বেশ সাজানো গোছানো হোটেল, তিন তারা হোটেলের মতই। ঘরে ঢুকে বাড়িতে জানিয়ে প্রথম এক কাপ কফি বানালাম হোটেলের ইলেকট্রিক কেটলিতে। যদিও কেটলি, কফি, চিনি সবই আমার ব্যাগে ছিল, সেগুলো বের না করে হোটেলের জিনিসগুলো দিয়েই কাজ সারলাম। কফি খেয়ে, হাত মুখ ধুয়ে, একটু ফ্রেশ হয়ে আবার বেরুলাম। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেটা ধরেই গেলাম, চৌমাথা ছাড়িয়ে সোজা এগোলাম। রাস্তার দু পাশে দোকানের সারি, এই রাতে সবই প্রায় বন্ধ, রাস্তায় টুরিস্ট ও প্রায় নেই বললেই চলে। এই জায়গা থেকেই শুরু বিখ্যাত ল্যাটিন কোয়াটার। কিছুদুর হেঁটে যেতেই দেখতে পেলাম একটা ব্রিজ, তলা দিয়ে বয়ে চলেছে সেইন নদী। রাস্তাটা এখানে অনেকটা চওড়া, ব্রিজের আগে দুভাগে ভাগ হয়ে নদীর পাশ বরাবর চলে গেছে দুদিকে। ম্যাপে দেখলাম এই ব্রিজটার নাম Pont Saint-Michel। যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে এই ত্রিমাথা, তার একটু আগেই একটা ত্রিভুজ রাস্তার মাঝখানে, দুদিক দিয়ে রাস্তা এসে একজায়গায় মিললে যেমন হয়, তেমন। আর সেই ত্রিভুজের মাঝখানে একটা ফোয়ারা, যার নাম Fontaine Saint-Michel। ১৮৬০ সালে গ্যাব্রিয়েল দেভিউডের বানানো এই স্থাপত্যের মাঝখানে সেন্ট মাইকেলের ব্রোঞ্জের মূর্তি যার হাতে উদ্যত তরবারি প্রস্তুত পায়ের নিচের অসুর বা ডিমন বধের জন্য। দুদিক দিয়ে উঠেছে চারটে লাল মার্বেলের স্তম্ভ যা প্রতিনিধিত্ব করছে চার গুণের – ইংরেজিতে যাদের নাম prudence, Fortitude, Justice আর Temperance। ফোয়ারার সামনে দুদিকে দুটো ড্রাগন, যাদের মুখ দিয়েও জলের ফোয়ারা।
ব্রিজটা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে একটু হেঁটে এলাম, নদীর ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে দাঁড়ানো যায় না, তাও অনেক লোক এই রাতেও নদীর পাড়ের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে, গল্প করছে, ছবি তুলছে। নদীতে ছোট সুদৃশ্য নৌকাও চলতে দেখলাম, যেরকম দেখেছি আমাদের ওখানে পার্ল নদীতে। নদীর উলটো দিকে, মানে যেদিক থেকে আমি এলাম, কিছু সুভেনিরের দোকান তখনও খোলা। আমার বাঁদিকে পড়লো একটা অট্টালিকা – মাপে দেখলাম সেটা প্যারিস পুলিশের কার্যালয়, নাম Prefecture de Police de Paris। আর আমার সামনে, অন্ধকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নত্রে দামে ক্যাথেড্রাল। আসার আগেই জেনেছিলাম, ক্যাথেড্রাল বন্ধ, কাজ চলছে। ২০১৯ এর ১৫ই এপ্রিল এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই স্থাপত্য, তার পর থেকেই অনুগামী ও দর্শকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাথেড্রালের দরজা। আমি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম সেখানে, শহরের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়েও অনুভব করা যায় যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে কত ইতিহাসের সাক্ষ্যে, কান পাতলে এখনও যেন শোনা যায় তার দীর্ঘশ্বাস। গা নিজের অজান্তেই ছমছম করে ওঠে। রাত বাড়ছে, হোটেলে ফিরতে হবে, শরীরটাও আর চলছে না। ফিরলাম উলটো মুখে। পেছনে ফেলে আসা পথে দাঁড়িয়ে থাকল নত্রে দামে, অপেক্ষায় কবে ফিরবে সে তার পুরনো গরিমায়।
হোটেলে ফিরে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া ব্রেড আর কফি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা লেপের তলায়। আসার আগে জেনে এসেছি, কাল সকাল ৭টা থেকে ব্রেকফাস্ট শুরু, চলবে ১০টা অবধি। রুমটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, খাটে শুয়ে কালকের প্ল্যান টা ভালো করে ঝালিয়ে নিলাম মোবাইলের ম্যাপে। কাল ঠিক করেছি সাড়ে ৭ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। আজকের ক্লান্ত শরীর কাল উঠতে পারবে তো সময়ে? জানি না, মোবাইলের অ্যালার্মই ভরসা। এখন বেঝেছে সাড়ে ১০টা। আজকের তোলা ছবি গুলো দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম সেটা বুঝতেই পারলাম না।