![](https://static.wixstatic.com/media/41d000_a5a016c0c12e235dd871ab8041e8bc40.png/v1/fill/w_1920,h_1160,al_c,q_95,enc_avif,quality_auto/41d000_a5a016c0c12e235dd871ab8041e8bc40.png)
সত্যি, না কি??
‘কি রে, এদিকে কোথায়?’ প্রশ্নটা শুনে পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখি, কানাইদা। দাঁড়াতেই হল, আমাকে দাঁড়াতে দেখে কানাইদা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর বাড়ি তো উল্টো দিকে, তাহলে এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?’
বললাম, ‘দেখতেই তো পাচ্ছো, ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তার মানে খাবার নিতে এসেছিলাম’।
‘হ্যাঁ, কিন্তু ক্যান্টিন তো বন্ধ’, কানাইদার গলায় কৌতুকের সুর।
‘সেটা তো আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, আসার আগে যদি জানতাম, তাহলে তো আর আসতাম না। সবাই বলল, আজ থেকে নাকি ক্যান্টিন খুলেছে, তাই দুপুরের খাবারটা নিতে এসেছিলাম’ অকপটে স্বীকার করলাম।
‘গুজব, বুঝলি, গুজব’ বিজ্ঞের মত বলল কানাইদা।
‘তুমি এখানে কি মনে করে?’
‘আমিও তোর মত, সেই গুজবের চক্করে’ কানাইদার গলায় আক্ষেপ, ‘বোঝা উচিৎ ছিল আমার। যাই হোক, বাড়ি ফিরবি তো খালি হাতে? চল, তোর সাথে কিছুদূর যাই।‘
এই প্রস্তাবে না করা যায় না। এখানে কানাইদার পরিচয়টা একটু দেওয়া দরকার। কানাইদা আমার সাথে প্রায় একই সময়ে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। কোন রাজ্যের লোক, ঠিক জানি না, তবে অবাঙালি, কিন্তু বাংলাটা আমার থেকে ভালো বলে। কি বিষয়ের ওপর গবেষণা জিজ্ঞাসা করতে একদিন বলেছিল, ’সে কি আর একটা, তবে ইন জেনারেল বলতে হলে, হিউম্যানিটি’। আমি জানি এখানে সেরকম একটা ডিপার্টমেন্ট আছে, তবে বিল্ডিংটা কোনদিকে জানি না। মাঝে মধ্যে দেখা হয় কানাইদার সাথে, অফিস যাবার পথে বা ফেরার সময়। চীনের নতুন বছরের ছুটিতে এই বছরও বাড়ি যায়নি, জিজ্ঞাসা করলে বলেছে, ‘কদিন পরে যাবো, এই তো এলাম’। এই ক’বছরে অনেকবার কানাইদার কাছ থেকে অনেকরকম সাহায্য পেয়েছি, পেপার পাবলিশ হচ্ছে না কিম্বা কোন কাজ আটকে গেছে, কানাইদা হাজির মনের জোর বাড়াতে, কাজ হয়ে গেছে কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারছি না – কানাইদা দেখিয়ে দিয়েছে, কারুর কোন ব্যবহারে মাথা গরম হয়েছে কিন্তু কিছু করতে পারছি না নিষ্ফল রাগে ফোলা ছাড়া – কানাইদা শান্ত ভাবে বুঝিয়েছে। এরকম আরও কত কি, সব লিখতে গেলে এই লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তো এহেন কানাইদার সাথে একসাথে আগেও ফিরেছি, বেশ মজার মজার কথা বলতে পারে লোকটা, তাই ভালোই লাগে। আজ যদিও মেজাজটা বিগড়ে ছিল, তাও বললাম, ‘চলো, আর কি করব? বাড়ি ফিরে আবার রান্না করতে হবে।‘
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর কানাইদাই প্রথম কথা বলল, ‘কি হলো, একবারে থম মেরে গেলি যে’। আমি কিছু বলছি না দেখে, তারপর নিজেই বলল, ‘আসলে গুজব জিনিসটাই এরকম বুঝলি, সত্যিটা জানার পর নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগে।‘
আমি বললাম, ‘আসলে রোজ রোজ রান্না করতে আর ভালো লাগছে না। কি যে করল না এরা, সারা পৃথিবী এখন এর ফল ভোগ করছে।‘
কানাইদা অবাক হয়ে বলল, ‘এরা করল মানে, কি করল?’
‘কেন, সবাই তো বলছে, উহানের ল্যাব থেকে ভাইরাসটা বাজারে ছড়িয়েছে। মানুষের কাজ এটা, রাজনৈতিক চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়।‘
‘রাজনৈতিক চক্রান্ত নয়, রাজনৈতিক গুজব বল।‘
‘গুজব?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘তা ছাড়া আর কি? আজকের ক্যান্টিনের ঘটনাটার মতই এটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।‘
‘সে তো তুমি বলবেই। এখানে থাকছ, রোজগার করছ, এই জায়গার নামে নিন্দে সইবে কেন?’
‘আরে সেটা একটা কারণ বটে, কিন্তু সেটাই সব নয়। আচ্ছা বলতো, ভাইরাস কি?’
আমি বললাম, ‘সেতো সবাই জানে, খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে, এরা খুব ছোট ডিএনএ বা আরএনএ এর টুকরো যার বাইরে থাকে একটা প্রোটিনের ঢাকনা। কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের কোষে, যাদের বলে পোষক কোষ, প্রবেশ করার পর এরা সেই কোষের জিনিসপত্র ব্যবহার করে নিজেরা সংখ্যায় বাড়তে থাকে আর সেই কোষ মারা যাবার পর অন্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এ তো ছোটবেলার পড়া জিনিষ।‘
‘বেশ, আর করোনা ভাইরাসের সম্পর্কে কি জানা গেছে?’
‘করোনা ভাইরাস এক রকমের আরএনএ ভাইরাস, এদের বাইরে থাকে লিপিডের আবরণ। যেটা এদের বৈশিষ্ট্য সেটা হল এই আবরণের গায়ে কাঁটার মতো কিছু জিনিষ থাকে যেটার সাহায্যে এরা পোষক কোষে লেগে যেতে পারে। আগের বার যে SARS হয়েছিল, সেটাও এরকম একটা করোনা ভাইরাস।‘
কানাইদা খুশি হয়েছে বলে মনে হল, বলল, ‘যেটা বললি না, সেটা হল এই কাঁটার মতো জিনিসগুলো মানুষের রক্তে থাকা একটা নির্দিষ্ট এনজাইমের সাথে লাগতে পারে, যার নাম Angiotensin-Converting Enzyme 2। আর এই বৈশিষ্টের জন্য SARS করোনা ভাইরাস পশুর শরীর থেকে মানুষের শরীরে আসতে পেরেছিল। এই নতুন করোনা ভাইরাস, যাকে বলা হচ্ছে SARS-CoV-2, তাদেরও এই বৈশিষ্ট্যটা আছে, বরং SARS এর থেকে বেশী মাত্রায় আছে। শুধু তাই নয়, যে জিনিসগুলো না থাকলে এই কাঁটার মতো জিনিসগুলো কাজ করবে না বা অ্যাকটিভেট হবে না, মানুষের শরীরে সেই কেমিক্যালগুলোও প্রচুর পরিমাণে আছে। এর আরও একটা গুণ আছে – এই কাঁটা গুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে এর দুটো অংশ – একটা দিয়ে কোষের গায়ে লাগে আর অন্যটা দিয়ে এই কোষগুলো কে ফাঁক করে ভেতরে ঢোকে।‘
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁ সে তো বুঝলাম। কিন্তু এই জিনিস তো ল্যাবেও বানানো যায়।‘
কানাইদা হেসে বলল, ‘ধীরে বন্ধু ধীরে। তুই জানিস নিশ্চয়, যে কোন কাজে পুরো মাত্রায় হাত দেবার আগে একটা প্রাথমিক পরীক্ষা করা হয়, যে কাজ টা করা লাভ জনক কিনা। ধর, তুই একটা প্রোডাক্ট বাজারে লঞ্চ করবি, তার আগে মার্কেটে পরীক্ষা করা হয়, যে পাবলিক এটার ব্যাপারে উৎসাহী কিনা। সে রকম নতুন কোন গাড়ির মডেল আসার আগে দেখা হয়, বিক্রি কেমন হতে পারে। এসবই করা হয় পুরনো রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে, অঙ্ক কষে বের করা যায় এই সব হিসেব। এখন এই সব কাজ কম্পিউটারে হয়, যাকে বলে কম্পিউটার মডেল। ঠিক তো?’
আমি সন্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘তাতে কি প্রমাণ হয়?’
কানাইদা বলে চলল, ‘SARS আক্রমণ হবার পর থেকে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু কম্পিউটার মডেল বানাতে শুরু করেছিলেন এটা দেখার জন্য যে মানুষের শরীরের কোন কেমিক্যালের সাথে করোনা ভাইরাস লাগতে পারে, আর লাগলেও, সেই বন্ধন কতটা মজবুত। এই নতুন করোনা ভাইরাস কে যখন সেই মডেলে পরীক্ষা করা হল, তখন দেখা গেলো যে ভাইরাসটা আগে যে এনজাইমের কথা বললাম, তার সাথে লাগছে ঠিকই, কিন্তু সেই বন্ধন ফেভিকলের মতো মজবুত নয়, এমনকি যে শক্তিতে SARS লাগতে পারত, তার থেকেও দুর্বল। যদি তাই হয়, তাহলে একটা কথা বল, যদি আমি এই ভাইরাসটা বানাবো বলে ঠিক করি, তাহলে আমি প্রথম তো এই মডেলে পরীক্ষা করে দেখবো যে এটা ঠিক ঠাক কাজ করছে কিনা। আমার মডেল যদি প্রথমেই আমাকে বলে, এই ভাইরাস দুর্বল বা ঠিক ঠাক কাজ করবে না, তাহলে আমি আর কি সেই কাজে অগ্রসর হব?’
ঢোঁক গিলে মানতেই হল, ‘না, হব না।‘
‘আমি-তুই না হলে কি হবে, নেচার হয়েছে। সে এমন ভাবে এই ভাইরাসের আকৃতি পাল্টে দিয়েছে, ওই যেটাকে আমরা বলি মিউটেশন, যে এই ভাইরাস ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছে। আর এই পুরো কাজটাই হয়েছে বাদুড় বা ওই জাতীয় কোন প্রাণীর দেহে। কি করে বোঝা গেলো, জানিস?’
বোকার মতো চুপ করে আছি দেখে, কানাইদা বলল, ‘মানুষের শরীরের করোনার সাথে আজ পর্যন্ত জানা বা পরীক্ষা হওয়া করোনা গুলোর আকৃতি ততটা মেলে না যতটা মেলে বাদুড় জাতীয় প্রাণীর দেহের করোনার সাথে। কিন্তু সেই ভাইরাস গুলো আজ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়নি সে ভাবে আর হলেও দেখা গেছে তারা মানুষের কোন ক্ষতি করতে পারে না। তাই তুই যদি ভাইরাসটা বানাতে চাইতিস, নিশ্চয়ই এমন কোন ভাইরাস থেকে বানাতি যেটা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক। তাই নয় কি?’
বিজ্ঞানীর যুক্তির সামনে স্বীকার করতেই হল, সেটাই করা স্বাভাবিক। তাও এতটা জ্ঞান একবারে শুনে মাথাটা কেমন করছিল, তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে মালটা এলো কি ভাবে?’
কানাইদা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সেটাই তো আসল প্রশ্ন। দ্যাখ, আজ পর্যন্ত দুটো সম্ভাবনার কথা শোনা গেছে। একটা হল, সরাসরি বাদুড় জাতীয় প্রাণীর দেহ থেকে আমাদের শরীরে এসেছে, যেমন হয়েছিল বেজী জাতীয় প্রাণীর থেকে SARS বা উটের থেকে MERS। এদের ভক্ষণ করার ফলে, সেটা বুঝতেই পারছিস। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে মানুষের শরীরে ঢোকার আগেই এই ভাইরাসের ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল ওই সব প্রাণীদের দেহে থাকাকালীনই। আর একটা মত হচ্ছে, মানুষের শরীরে ঢোকার পর এদের ক্ষতি করার ক্ষমতা জন্মায়। ওই কাঁটার মতো জিনিসগুলো যেগুলো দিয়ে ওরা মানুষের কোষে লাগছিল, সেগুলো আরও শক্তিশালী হয়, আগে যে বলেছিলাম ফাঁক করে ঢোকার ক্ষমতা, সেটা এই সময় আসে। এই জিনিস কিন্তু বাদুড় এর করোনার নেই, মানুষ ছাড়া এই জিনিস পাওয়া গেছে প্যাঙ্গলিন নামক প্রাণীর দেহে। তাই এটা মনে করা হচ্ছে, প্রথমে বাদুড়, সেখান থেকে প্যাঙ্গলিন হয়ে করোনা মানুষের শরীরে ঢুকেছে। আর প্যাঙ্গলিন এর ওপর কাজ কিন্তু মানুষে ধরা পরার পর তারপর শুরু হয়েছে। তাই বুঝতেই পারছিস, এটা পুরোপুরি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে, মানুষ চাইলেও এই জিনিস করতে পারত না।‘
‘এত কথা জানলে কোথা থেকে, কানাইদা?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
‘আরে, কদিন আগে এই কাজের ফলাফল গুলো প্রকাশ পেয়েছে নেচার পত্রিকায়। মনে রাখিস, বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিন্তু চীন দেশীয় লোক একজনও নেই, সবাই আমেরিকার।‘
‘তাহলে, আমেরিকার লোকজন যে উল্টো কথা বলছে?’
‘তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষার বা বিজ্ঞানের সাথে এদের অনেকেরই কোন যোগাযোগ নেই রে। তবে শুধু আমেরিকা বলে না, সব দেশেই কিছু লোক এমন থাকে, মিডিয়া থাকে, লোক জনকে যারা সত্যি কথাটা জানায় না। আর আমরাও ভাবি, সত্যি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছেন যখন, তখন উনি কি আর বাজে কথা বলবেন? জেনেই বলছেন নিশ্চয়। আমরাও মেতে উঠি, তাই বিজ্ঞান হাজার বার অন্য কথা বললেও, সেগুলো বিশ্বাস হয় না। আসলে কি জানিস তো, মানুষ নিজের অক্ষমতার একটা দোহাই সব সময় তৈরি করে রাখে। এই সময় সেগুলো আরও ভালো করে বোঝা যায়।‘
আমি তবুও হাল ছাড়তে নারাজ, ‘বেশ মেনে নিলাম…’ কানাইদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু ওয়েট কর। বকে বকে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চল, কোথাও একটু বসে গলা ভেজাই।‘
সত্যি, না কি??
সামনে একটা রেলিং দেওয়া পুকুর, তার চারপাশে কাঠের বেঞ্চ পাতা। শীতকালের দুপুর, তার দ্রুত ফুরিয়ে আসা রোদ টুকু পিঠে মেখে বসতে খারাপ লাগছিল না। কানাইদা ব্যাগ থেকে দুটো দই এর প্যাকেট বের করে একটা আমাকে দিয়ে অন্যটায় স্ট্র লাগিয়ে চোঁ করে টেনে বলল, ‘যাই বলিস, এই দই গুলো কিন্তু হেভি বানায় এরা।‘ দই মানে আমাদের ওখানকার মাদার ডেয়ারির দই এর মতো, তবে পাতলা, আর খেতে সত্যি খুব ভালো। আগেও দেখেছি, কানাইদার ব্যাগে দই থাকবেই, জিজ্ঞাসা করলে বলেছে, ‘কি করব, ছোটবেলার অভ্যেস, ছাড়তে পারিনি এখনও।‘
আরও মিনিট দুয়েক মন দিয়ে দই খেয়ে রুমালে মুখ মুছে কানাইদা বলল, ‘হ্যাঁ বল, কি বলছিলি?’
যে প্রশ্নটা একটু আগে করতে গিয়ে থেমে যেতে হয়েছিল, সেটা এবার করে ফেললাম, ‘আমি মেনে নিলাম যে এই জিনিস এখানে তৈরি হয়নি, কিন্তু এরা আরও একটু আগে তো জানাতে পারত? তাহলে তো আজ এই দিন দেখতে হতো না।‘
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কানাইদা বলল, ‘সত্যি রে, এইটা একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তবে তোর টাইম লাইনটা মনে আছে?’
‘কিসের টাইম লাইনের কথা বলছ?’
‘আরে এটা যেভাবে শুরু হল আর তারপর ছড়িয়ে পরল। তুই তো তখন এখানেই।‘
‘হ্যাঁ, সে মনে আছে কিছুটা, একদম তারিখ ধরে ধরে মনে নেই যদিও।‘
‘তারিখ লাগবে না, এমনিই বল – এখানে প্রথম কবে শোনা গেল এই ভাইরাসের কথা?’
‘ডিসেম্বরের শেষ দিকে, আমি জানুয়ারীর প্রথমে ফিরলাম বাড়ি থেকে, এসে শুনলাম। হ্যাঁ, ওই সময়।‘
‘বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর, উহান মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ নতুন এক ধরণের ভাইরাস এর কথা জানা যায়। তারপর, ২৩ শে জানুয়ারী থেকে পুরো শহরটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর এক সপ্তাহ পর ডব্লিউএইচও এটাকে গ্লোবাল এমারজেন্সি বলে ঘোষণা করে। এই অবধি মিলছে?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে, বলে যাও’।
‘এই সময় বাকি পৃথিবীর ধারণাটা কিরকম ছিল?’
‘আমি কি করে জানবো? তবে যতদূর মনে পড়ছে, আমেরিকা জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি ওয়ার্নিং দিয়েছিল, তার কিছুদিন পর এই দেশের লোকদের ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিল ফেব্রুয়ারীর প্রথম থেকে। ইউরোপ খুব একটা গা করেনি, বেশ কিছু দেশ তাদের নিজেদের লোকজনকে উহান থেকে বের করে নিয়ে গেছিলো, ইন্ডিয়া যেমন‘।
কানাইদা খুশী হয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। তবে শুধু ইন্ডিয়া বলে নয়, এশিয়ার অনেক দেশ এই সময় যে কাজটা করেছিল, সেটাই মস্ত ফারাক করে দিয়েছে আমেরিকা বা ইউরোপের সাথে আমাদের। যেমন ধর, ইন্ডিয়া কবে থেকে এয়ারপোর্টে চেক আপ করা শুরু করেছে?’
আমার মনে ছিল, বললাম, ‘জানুয়ারীর ২১ তারিখ থেকে।‘
‘তার মানে যেদিন চীন ঘোষণা করেছিল যে এই রোগটা সিরিয়াস হতে পারে, তার প্রায় একই সময় থেকে। আর সেই সময় আমেরিকা কি বলেছিল?’
আমি জানতাম না, তাই চুপ করে থাকলাম। কানাইদা বলে চলল, ’২১ তারিখই আমেরিকাতে প্রথম কেস টা ধরা পরে। পরেরদিন প্রেসিডেন্ট বিবৃতি দিলেন যে চিন্তার কিছু নেই, সব আমাদের কন্ট্রোলে আছে। শুধু এই সময় নয়, জানুয়ারীর প্রথম থেকেই আমেরিকা জানতো, একটা ভাইরাস চীনে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রেসিডেন্ট কে বারবার বলা সত্ত্বেও গত মাস মানে মার্চ অবধি কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি ব্যাপারটাকে। অন্যদিকে ইন্ডিয়ার কথা ভাব, এত গরীব দেশ হওয়া সত্ত্বেও কত আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছিল, লক ডাউন পর্যন্ত করে ফেলল পুরো দেশ টাকে, যেটা চীনও করতে পারেনি। নিজেদের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আমাদের টাকা আছে, উন্নত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা আছে, ও ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব – তার ফল আজ গোটা আমেরিকা ভুগছে। এখন যখন দেখছে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, কারুর ওপর দোষ তো চাপানো চাই, তাই করছে। তাই বলছে, আরও আগে বলনি কেন? আরে, তোমরা তো জেনেও কিছু করনি। যদি কিছু নাই জানতে, তাহলে তোমাদের দেশের বর্ডার বন্ধ করলে কেন চাইনীজদের জন্য? তার মানে তোমরা জানতে, কিন্তু কোন ব্যবস্থা নাওনি দেশের ভেতরে। আসলে এই জিনিস রাজনীতির খেলা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।‘
ভাবলাম ব্যাপারটা যখন খোলসা হচ্ছেই, তখন পুরোটাই হোক। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে ইউরোপ, সেখানেও তো যা তা অবস্থা, সেখানে কি করে হল?’
কানাইদা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ইউরোপের ব্যাপারটা কিন্তু পুরোপুরি আলাদা। জানিস, ইউরোপে কোথা থেকে এটা ছড়াল?’
‘জলের মত সোজা, ইটালি থেকে’, উত্তরটা তৈরিই ছিল, বলে দিলাম।
‘কেন ইটালি? সেটা জানিস কি?’
না বলতেই হল, সত্যি তো, কেন ইটালি সেটা তো মাথাতেই আসেনি।
কানাইদা বলল, ‘এই ব্যাপারটার সাথে ইতিহাসের একটা যোগ আছে। খুব ছোট করে বলছি, শোন। কোল্ড-ওয়ারের কথা জানিস নিশ্চয়ই, সেই সময় ইটালি ছিল দারুণ কাপড়ের দেশ। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইটালি থেকে এই সব কাপড় যেত। যুদ্ধ শেষ হবার পর যখন ইটালির অর্থনীতি টলমলে, তখন চীন উপস্থিত হয়ে বলল, আমরা কম খরচে লেবার সাপ্লাই দেবো, তোমার কোন চিন্তা নেই। ইটালি রাজি হল। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেলো এই সব লেবাররা আস্তে আস্তে ইটালির অর্থনীতির ওপর পুরো কব্জা করে ফেলতে লাগল, ইটালিয়ান মালিকদের সরিয়ে তারাই ব্যবসা করতে লাগল। অনেকটা যেমন কলকাতায় বাঙালির থেকে মাড়ওয়ারি ব্যবসাদার বেশী, সে রকম। তারা কাঁচা মাল আনতে লাগল চীন থেকে, লেবার চীনের, কিন্তু ব্যবসা ইটালিতে। যা রোজগার হতো, স্বাভাবিক ভাবেই সেটা চলে যেতে লাগল চীনে। সেই থেকে আজ অবধি ইটালি বেরোতে পারেনি চীনের কবল থেকে, আজও দেশটা চীনের অর্থনৈতিক সাহাজ্যের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি ইটালির একটা বন্দরও আজ চীনের অধীনে। তাহলে বুঝতেই পারছিস, এরকম ব্যবসা মানে কতো লোকের যাতায়াত হয় দুটো দেশের মধ্যে। যখন ইন্ডিয়া বা বাকি এশিয়ান দেশ গুলো চীনের সাথে বর্ডার বন্ধ করতে লাগল, ইটালি বলল, আমরা কেন করব? আমাদের এরকম রেসিস্ট মনোভাব নেই। এই মনোভাব যে নেই সেটা প্রমাণ করার জন্য একটা কোম্পানি চালুও করে দিল নতুন জিনিস-নাম দিল Hug a Chinese। এসব কিন্তু ঘটছে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে, যখন চীনে অন্তত চারশো লোক মারা গেছে। এবার যা হবার তাই হল, প্রথম ঘটনাটা ঘটলো এক উহান ফেরত দম্পতির হাত ধরে। এবার তড়িঘড়ি প্লেন চলাচল বন্ধ করা হল, কিন্তু ততদিনে শখানেক লোক তো ঢুকেই পরেছে। এই পুরো জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। শুধুমাত্র অবাধ যাতায়াত, কোনরকম স্ক্রিনিং ছাড়াই দেশের ভেতর ঢোকা, এই করে করে ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মত দেশে এটা ছড়িয়ে পরল। যতদিনে বোঝা গেলো, ততদিনে এই দেশগুলো ইউরোপের বাকি দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছে ভাইরাসটাকে। অবশ্য শুধু ইউরোপ বলে নয়, এখান থেকে ভাইরাসটা ছড়িয়েছে ইউরোপের বাইরেও, যেমন ইন্ডিয়াতে। ইন্ডিয়াতে প্রথম কেসটা কিন্তু উহান ফেরত এক ছাত্রের, কিন্তু তাকে সুস্থ করে তুলে আর চীনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে, ইন্ডিয়া কিন্তু বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু ইন্ডিয়াতে ছড়াল ইউরোপ থেকে বা বলা ভাল, ইটালি থেকে যাওয়া ট্যুরিস্টের হাত ধরে। মনে রাখিস, ইউরোপ বা মধ্য এশিয়ার দেশ গুলোর সাথে ভারত কিন্তু যাতায়াত বন্ধ করেছে অনেক পরে, মার্চ মাসের ১৮ তারিখ। কিন্তু ততদিনে যা হবার, তাতো হয়ে গেছে।‘
এই অবধি বলে কানাইদা থামল। দই খাওয়া শেষ, প্যাকেটটা কাছের ডাস্টবিনে তাক করে ছুঁড়ে দিয়ে কানাইদা বলল, ‘চল, এবার তাহলে ওঠা যাক।‘
সত্যি, না কি??
হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে তুমি বলছ চীন এর কোন দোষ নেই? এরা সাধু, ধোয়া তুলসীপাতা, আর সবাই এত গালাগালি দিচ্ছে, সেগুলো সব মিথ্যে?’
কানাইদা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সেটা তো আমি বলিনি। নিশ্চয় দোষ আছে, বড় রকম দোষ আছে। যেমন ধর, নতুন রোগ যার মাথা মুণ্ডু কিছুই জানা নেই, সেটা কতটা ক্ষতিকারক সেটা বুঝতে সময় লাগবে এটা মানা যায়। এই সময় নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায়নি, মানুষ থেকে মানুষে এটা ছড়াতে পারে কিনা। এটা জানুয়ারীর প্রথম দিকের কথা। কিন্তু যেটা মারাত্মক ভুল, সেটা হল এটা জানতে পারেও চুপ করে থাকা। ১৩ তারিখ থাইল্যান্ড থেকে রিপোর্ট আসার পরই এরা বুঝেছিল, যে মানুষ থেকে আরেক মানুষে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পরতে পারে। আমি যতটুকু জেনেছি, ১৪ তারিখে একটা মিটিংএ এই নিয়ে আলোচনাও হয়, সেই মত বিভিন্ন প্রদেশ কে নির্দেশ দেওয়া হয়, তোমরা ক্লিনিক খোল, জ্বর হলে টেস্ট করাও, ডাক্তার নার্সদের জন্য সংক্রমণ নিরোধক পোশাকের ব্যবস্থা করো। কিন্তু সাধারণ মানুষকে কিচ্ছু জানানো হল না। এই সময় নিউ ইয়ার চলছিল, লোক জন সারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগল। এরও তিন দিন পর ১৭ তারিখ থেকে দেশ জুড়ে টেস্টিং শুরু হল, আর হাজারে হাজারে লোকের ধরা পড়তে লাগল। পরিস্থিতি দেখে ২০ তারিখ এই দেশের প্রেসিডেন্ট স্বীকার করলেন, চাপ হয়েছে। লোককে জানানো হল, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পরতে পারে। কিন্তু এই একটা সপ্তাহ খুব মারাত্মক হয়ে গেলো। এই ভুল ক্ষমার অযোগ্য। আর এর সাথে যোগ কর ডব্লিউএইচও এর ভূমিকাটা। একটা এত বড় সংস্থা, তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। পুরো এক মাস পর এটাকে গ্লোবাল এমারজেন্সি বলে ঘোষণা করা যখন পৃথিবীর এতগুলো দেশে ভাইরাসটা ছড়িয়ে পরেছে, আর তারও প্রায় দেড় মাস পর এটাকে প্যান্ডেমিক বলে জানানো, এই ভুলেরও কোন ক্ষমা নেই‘।
অবশেষে একটু জয়ের গন্ধ পেয়ে আরও মরিয়া হয়ে উঠলাম, ‘তাহলে তুমি স্বীকার করছ? এটাও মানছ যে রাজনৈতিক চাপে পরে ডব্লিউএইচও এর এই কাজটা করা উচিৎ হয়নি?’
কানাইদা বলল, ‘নিশ্চয়ই, যেটা ভুল সেটা তো ভুলই, সেটাকে তো আর জোর করে ঠিক করা যায় না। যদি ওই এক সপ্তাহ দেরী না হতো, ডব্লিউএইচও যদি চীনের চাপ অগ্রাহ্য করে যেটা নিয়ম, যেটা ওদের ওয়েবসাইটে লেখাও আছে, সেটা মেনে চলত, তাহলে আজকের দিনটা হয়তো এত খারাপ হতো না। অবশ্য এটাও ঠিক যে কোন একটা রোগকে এপিডেমিক বলে ঘোষণা করে দিলে, আর তারপর সেটা যদি ততটা ক্ষতিকারক না হয়, তখন সবাই দোষটা ডব্লিউএইচও কেই দিত। যেমনটা হয়েছিল SARS এর বেলায়। এটাও মাথায় রাখিস, এই সময় পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলো কিন্তু এই রোগটাকে কোন গুরুত্বই দেয়নি। সেই পরিস্থিতিতে এটাকে এপিডেমিক বলে দেওয়ার সাহসটা ডব্লিউএইচও দেখাতে পারেনি। এই টালবাহানায় অনেক দেরী হয়ে গেলো।‘
আমি আরও একটু উস্কে দেবার লোভ সামলাতে না পেরে বললাম, ‘তাহলে যে বলছে, এখানে আরও বেশী লোক মারা গেছে, আমাদের এত বেশী আর ওদের এত কম।‘
কানাইদা একটা তাচ্ছিলের হাসি হেসে বলল, ‘তাহলে গোটা এশিয়া মহাদেশে এত কম লোক মরল কেন? এগুলো তো সব গরীব দেশ, হাসপাতাল নেই, উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই আমেরিকার মত, তাহলে? আসলে এরা কাজ শুরু করেছে অনেক আগে থেকে, তাইওয়ান, সাউথ কোরিয়ার মত দেশে তাই আজ এই পরিস্থিতি অনেক নিয়ন্ত্রণে, ইন্ডিয়াতেও চলে আসবে খুব শীগগিরই। আর একটা কথা ভুলে যাস না, এই দেশটা নামেই গণতন্ত্র, এখানে কিন্তু শাসন ব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রের মত চলে, সরকার যা বলে সাধারণ লোক তাই মানতে বাধ্য। এর যেমন অনেক খারাপ দিক আছে, তেমনি ভালও তো কিছু আছে। এই জিনিস চলে বলে, এখানে লোককে আটকানো গেছে জোর করে, যে জিনিস পৃথিবীর অনেক দেশে ভাবাই যায় না। চীন যেরকম উহান লক করে দিয়েছিল, দেশের সমস্ত রিসোর্স ওই শহরটায় নিয়ে গেছিল, শুধুমাত্র ভাইরাসটাকে ওখানে আটকে রাখার জন্যে। ওই সময় উহান শহরে যা স্বাস্থ্য-পরিষেবা ছিল, তা যে কোনো অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশের থেকে ভালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সরকারি হিসেবে উহানে মৃত্যুর হার যদি দেখিস, সেটা ৩৪.৫ শতাংশ, প্রায় কাছাকাছি ইউরোপের দেশগুলোর। শহরটাকে বন্দী করে এরা কিছুটা সফল সারা দেশে এটা প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পরা আটকানোর কাজে। তবে এটা অস্বীকার করব না যে এরা যে সংখ্যা বলছে আক্রান্ত বা মৃত লোকের, সেটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়।‘
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে বাকিদের সাথে তুমি একমত?’
কানাইদা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাকি মানে তুই কাদের কথা বলছিস, সেটা স্পষ্ট করে বল আগে। তুই যদি ওই প্রোপ্যাগান্ডা করা রাজনীতির লোকগুলোর সাথে আমার কথা মেলাতে যাস, তাহলে বলব – না। কিন্তু তুই যদি বিজ্ঞানীদের কথা বলিস, তাদের সাথে আমি একমত।‘
অবধারিত ভাবে প্রশ্ন করলাম, ‘তাঁরা কি বলছেন, শুনি?’
কানাইদা একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,’দেখ, এই রকম এপিডেমিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কোন দেশ সঠিক সংখ্যা বলতে পারে না। তার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমে ভাব, চীনের জনসংখ্যার আর জনঘনত্বের কথা। এরকম প্রচুর লোক আছে, যারা টেস্টই করাতে পারেনি, কারণ হসপিটালগুলো তখন সব ভর্তি। বাড়িতেই ছিল, এদের মধ্যে কেউ সেরে উঠেছে, কেউ মারা গেছে।‘
আমি মাঝখানে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেরে উঠেছে মানে? করোনা হলে আর চিকিৎসা না হলে কেউ সারে নাকি?’
কানাইদা খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তুই কি ভাবিস করোনা মানেই মৃত্যু? এটা আরেকটা ভুল ধারণা। শরীরের ইমিউনিটির কথা শুনিস নি? যদি তোর শরীর লড়াই করতে পারে এই ভাইরাসের সাথে, তাহলে তোর কোন লক্ষণ প্রকাশই পাবে না। এটা আরেকটা কারণ রোগীর সংখ্যা কম হবার। তারা তো জানেই না, তাদের শরীরে করোনা আছে, তাই টেস্টও হয় না, ধরাও পরে না। তাই এখন দেখ, এরকম কত কেস পাওয়া যাচ্ছে এখানে।‘
অন্য দিকে প্রসঙ্গ চলে যাচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘তুমি কি বলছিলে বল।‘
কানাইদা বলতে লাগল, ‘প্রাথমিক ভাবে এই দুটো কারনের জন্য, এক - উপযুক্ত পরীক্ষা ব্যবস্থার অভাব আর দুই – রোগের কোন লক্ষণ শরীরে প্রকাশ না পাওয়া, এই দুইয়ের জন্য পৃথিবীর যে কোন দেশে যে কোন এপিডেমিকে আসল সংখ্যা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। যেমন ধর, এই ক’দিন আগে ইংল্যান্ডে একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে সরকারি হিসেবের থেকে মৃত্যু সংখ্যা অন্তত একচল্লিশ শতাংশ বেশী। কি করে হল জানিস? সরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীর সাথে যারা বাড়ীতে বা কমিউনিটি হোমে মারা গেছেন, তাদের সংখ্যাটা যোগ করে। এর সাথে যোগ কর আরও একটা ফ্যাক্টর – কেউ নিজেকে দুর্বল বলে দেখাতে চায় না। তাই দেখবি এই রকম সব পরিস্থিতিতে দুটো সংখ্যা থাকে – একটা সরকারী আর একটা বেসরকারি। মজার ব্যাপারটা হল, সরকারী সংখ্যাটা সব সময় কমের দিকে থাকে। সে কোন অগ্নিকান্ডে লোক মারা যাওয়া হোক, কি ভুমিকম্পেই হোক, আসল সংখ্যা সব সময় কমিয়ে বলা হয়। আর এটা তো এপিডেমিক, এর সাথে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক – সব বড়বড় ব্যাপার।‘
‘কিন্তু সঠিক সংখ্যাটা না জানালে, বাকি দেশগুলো তৈরি হবে কি করে? তারা তো ব্যাপারটার গুরুত্বটা বুঝতেই পারবে না।’
কানাইদা বলল, ‘সে তো একশবার। এটা তো আরও একটা ভুল, যদিও এই ভুলটা কতটা ইচ্ছাকৃত, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। বাদ বাকি দেশ গুলোর মত এখানেও রাজ্য-কেন্দ্র ভাগ আছে। কেন্দ্র এখানে খুব কড়া রাজ্যের ওপরে। তাই রাজ্যগুলো অনেক সময় কেন্দ্রকে জানাতে ভয় পায় বা দেরী করে জানায়। আমাদের দেশে ভাব, লোকে বলছে পশ্চিমবঙ্গে নাকি আক্রান্ত আরও বেশী, সরকার জানাচ্ছে না। এখানেও তাই হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এখন যখন এই নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে, তখন এরা আবার নতুন করে খুঁটিয়ে দেখছে। তুই জানিস, এখানে নতুন করে টেস্ট শুরু হয়েছে। উহানের প্রায় এগারো হাজার লোকের রক্ত পরীক্ষা হয়েছে যারা জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসের মধ্যে এই শহরে ছিল, কিন্তু কোন রোগের লক্ষণ ছিল না। পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে এদের শরীরে এই রোগের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় কিনা। যদি পাওয়া যায়, তাহলে বোঝা যাবে এরা আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু এদের শরীরের ইমিউনিটি এদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই রকম পরীক্ষা SARS এর বেলাতেও করেছিল এরা। এই পরীক্ষায় বেশীর ভাগ লোকের মধ্যে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছিল, যেটা থেকে বোঝা গিয়েছিল যে অ্যান্টিবডিগুলো এই মানুষদের এবং তাদের আশেপাশের মানুষ জনকে প্রোটেক্ট করেছিল। এই পরীক্ষা থেকে এটাও বোঝা যাবে, যে এই ভাইরাসটা থাকবে আরও বেশ কিছুদিন যেরকম সাধারণ জ্বর থাকে, নাকি SARS এর মত চলে যাবে। তাছাড়া এটাও বোঝা যেতে পারে, যে মানুষদের ইমিউনিটি কম, তাদেরই কি এই ভাইরাসটা বেশী আক্রমণ করে।‘
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে তো কাজ হচ্ছে এখানে’।
কানাইদা বলল, ‘সে তো হচ্ছে, কিন্তু এদের এই তিনটে ভুল – এক, ওই একটা সপ্তাহের দেরী, দুই, ডব্লিউএইচও কে নিজেদের বাগে রাখার চেষ্টা, আর তিন, সঠিক সংখ্যাটা না জানতে পারা বা জানলেও না জানানো - এগুলোকে অস্বীকার করি কি করে? যে কারণেই হয়ে থাকুক না কেন, এগুলো তো ভুল। কিন্তু আমার মতে যেটা আরও বড় ভুল, সেটা হল না জেনেও কিছু না করা। যে ভুলটা অন্তত এরা করেনি, পশ্চিমের দেশ গুলো যেটা করেছে। এরা যেমন আগে জানালে এই জিনিসটাকে একটু হলেও বাগে রাখা যেত, তেমনি বাকি দেশগুলো জানতে পেরেও চুপ করে বসে না থাকলে এত লোক মারা যেত না। এই সময় যখন সব থেকে বেশী সাহায্য দরকার পৃথিবীর ধনী দেশ গুলোর থেকে, সেই সময়ে ডব্লিউএইচও এর টাকা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও তাই আরও বড় ভুল। এখানকার লোকজন, সরকার জানার পর চেষ্টা করেছে, কষ্ট হলেও সব নির্দেশ মেনে চলেছে, সরকার দশ দিনের মাথায় হাসপাতাল বানিয়ে দিয়েছে, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হলেও জলের মত রোগের পেছনে টাকা খরচ করেছে, এখানকার বিজ্ঞানীরা ভাইরাস এর জিনোমিক গঠন বের করে সবার সাথে শেয়ার করেছে। এই কাজগুলোর ফল আজকে পাচ্ছে এরা, আসতে আসতে দেশটা স্বাভাবিকের দিকে ফিরছে। তাই আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করিস, আমি বলব এই সময় বেশী দরকার এই ভুলগুলো না দেখে, এরা কি ঠিক করেছে, সেটা দেখো। ভুল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক টা কদিন পরে করলেও চলবে। দেখ, খারাপ দিকটা দেখতে পায় সবাই, ওটাই মানুষের ধর্ম – অন্যের সমালোচনা করে মানুষ নিজের ভুলটাকে ঢাকতে চায়, তবে ভালো দিক থেকে শিক্ষাটা নিতে পারে ক’জন?’
কানাইদার এই কথাটার সাথে জুড়ে দিলাম খবরে পড়া নেতাদের একটা উক্তি, ‘এটা ঠিক বলেছ, এই সময় সব দেশের একসাথে কাজ করা উচিৎ।‘
কানাইদাকে বার খাইয়ে লাভ নেই, বলল, ‘এটা তো রাজনৈতিক মন্তব্য হয়ে গেলো রে। আর যদিও এটা বলছে সবাই, করছে বা ভাবছে ক’জন? এখানে রাজনীতি আগে, মানুষের জীবন পরে। সবাই এখন সবার দিকে আঙ্গুল তুলতে ব্যস্ত। কখনও বলছে, ভাইরাস এখানে তৈরি করা হয়েছে, কখনও বলছে ইচ্ছে করে দেরী করে জানিয়েছে, আবার কখনও বলছে এত কম লোক মারা যায় কি করে, যেন কি আফসোস – আরও বেশী লোক মরলো না কেন? তাহলে তো নিজের দেশে মুখ দেখাতে পারতাম। হুমকি, খিস্তি – কিছুই বাদ নেই। পৃথিবীর দুটো সবথেকে বড় দেশের এই আচরণ খুব আনফরচুনেট। কেউ কিন্তু বলছে না, ঠিক ভুলটা পরে বিচার করব, আগে মানুষগুলোকে বাঁচাই। যেখানে যতটুকু ভালো, আজকের দিনে সেটা আগে নেওয়া দরকার। এর পর অনেক সময় পরে থাকবে খারাপ জিনিসগুলো নিয়ে কামড়া-কামড়ি করার।‘
কথা বলতে বলতে সুপার মার্কেটের সামনে এসে পরেছি। কানাইদা ‘একটু ওয়েট কর, আমাকে মিছরি কিনতে হবে। আসছি এক্ষুনি।‘ বলে হাওয়া। আমি আর কি করি, বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম এতক্ষণ ধরে শোনা কথাগুলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাল্টা যুক্তি হাতড়াতে লাগলাম, যাতে কানাইদা বেরোলেই ক্যাঁক করে চেপে ধরতে পারি, শেষে একটাও না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।
সত্যি, না কি??
কানাইদা বেরোলে, আমি এবার কথাটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, ‘বেশ রাজনীতির ব্যাপারটা মেনে নিলাম। তারা না হয় বোঝে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ, পড়াশুনো জানা মানুষ, শিক্ষিত লোকজন – তারাও তো রেগে গেছে এই দেশটার ওপর। চেনাশোনা অনেক লোককে বলতে শুনছি, চীন শেষ করে দিল, কি জিনিস পাঠাল, দেখলেই মারবো। এদের রাগ হওয়াটাকে তুমি কি বলবে?’
কানাইদা হোহো করে হেসে উঠে বলল, ‘তোকে যদি এতদিন বাড়িতে বন্দী থাকতে হতো, তাহলে তোরও রাগ হতো, ওতে দোষের কিছু নেই। এবার একটা জায়গা তো চাই, এই রাগ গুলোকে প্রকাশ করার। কোথায় করবে? কাকে দোষ দেবে? এরকম অবস্থায় পরলে সাধারণ মানুষ দেশের নেতাদের দিকে তাকায়, দেখে তারা কাকে ধরেছে। আমাদের দেশ এত বছর পরাধীন ছিল, সাহেব-মেমদের সাথে কাটিয়েছে, তাদের প্রতি অন্ধ একটা আনুগত্য আজও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। অনেকে এটাকে বলে, কলোনিয়াল হ্যাং-ওভার। তার জন্য আমরা এখনও ইংল্যান্ড বা আমেরিকা যা বলে, ভেবে নিই, ঠিকই তো বলছে, এটা তো চীনের দোষ। অতএব তেড়ে গাল দাও ব্যাটাদের। আর জানিসই তো, আমাদের দেশের লোকের রাগ চীনের ওপর অনেক দিনের। প্রথমত, এই দেশটা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে, তার মানে আমাদের শত্রু। এদের জিনিস আমাদের দেশের মার্কেট ছেয়ে ফেলেছে, আমরা ব্যবহার করি রোজ, কিন্তু খারাপ হলেই কি বলি? – ও, চায়না মাল তো, এরকম তো হবেই। খারাপ হয়ে যাওয়া জিনিসটাকে ফেলে দিয়ে, আবার একটা সেই মেড ইন চায়নাই কিন্তু কিনে আনি। কিন্তু এদের জিজ্ঞাসা কর একবার – ভাইরাস কি জিনিস? দেখবি, এদের বেশীর ভাগ সেটাই জানে না। যারা জানে, তারাও আজ খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে ভাবতে চায় না। এদের অনেকে রীতিমতো পড়াশুনো জানা মানুষ, নিজের বিচার-বুদ্ধি আছে, কিন্তু সেগুলোকে কাজে না লাগিয়ে এরা গুজব বিশ্বাস করতে ভালবাসে। ওই যে তোকে একটু আগে বলছিলাম না, যে গুজবটা আমরা একবার বিশ্বাস করি, সেটা মিথ্যে হতে দেখলে খুব রাগ হয় নিজের ওপর, আজকের দিনে কারুর আর নিজের ওপর রাগ করার সময় নেই, তাই সত্যিটা খোঁজার চাড়টাও নেই।‘
আমি এবার মরিয়া হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে এদের রাগটাকে তুমি অযৌক্তিক বলে মনে করো?’
কানাইদা এবার আমার দিকে ফিরে বেশ জোরের সাথে বলল, ‘এদের রাগটাকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করি না, কিন্তু রাগের বহিঃপ্রকাশটাকে করি বৈকি। এদের যে ভুল, সেগুলোর জন্য রাগ করা একশো বার সঙ্গত, কিন্তু গুজব বিশ্বাস করে, ভিত্তিহীন কারণে সেই রাগ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলাটাকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করি। আর সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ একটা দেশ, একটা জাতির ওপর করাটাকেও আমি শিক্ষিত মানসিকতার পরিচয় বলে মনে করি না।‘
আমি বললাম, ‘উহানে যখন এই জিনিস শুরু হয়েছিল, তখন লোকে বলেছিল – কেন যে এরা এসব খায়? সাধারণ মানুষের খাবার খেতে পারে না? এই যুক্তি তো পুরো দেশের ক্ষেত্রে খাটে।‘
কানাইদা বলল, ‘না খাটে না। তুই তো প্রায় দু’বছর হয়ে গেলো এখানে আছিস। বাইরে অনেকবার খেতে গেছিস। কটা হোটেলে চেনা খাবারের বাইরে খাবার দেখেছিস বা খেয়েছিস?’
স্বীকার করতেই হল, এখনও পর্যন্ত একটাতেও না।
কানাইদা হেসে বলল, ‘তাহলে? আসলে এটাও একটা গুজব, বা বলা ভালো আদ্যিকাল থেকে চলে আসা একটা ধারণা, যে এখানকার লোকেরা সাপ, ব্যাং, আরশোলা এসব খায়। ওরে সময় পাল্টেছে, পুরনো বা গ্রামের দিকের লোক ছাড়া এখানে বেশীরভাগ মানুষ আমাদের মতন চিকেন, মটন, গরু-এই সব খেয়েই থাকে। যেমন ধর, কয়েক বছর আগেও এখানে যে কোন হোটেলের ভেতরে বসে সিগারেট খাওয়া যেত, এখন যায় না। আজকালকার জেনারেশন এই জিনিসগুলো বোঝে, মানে। নতুন নতুন আইন করে এসব বন্ধ করা হচ্ছে। উহানের যে মার্কেট থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, সেখানে বেআইনি কাজ হচ্ছিল। বন্য প্রাণী হত্যা বা তাদের খাবার বা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা - এখনও রয়ে গেছে পৃথিবীর অনেক দেশে। দেশের সরকার চেষ্টা করে এসব বন্ধ করার, কিন্তু কিছু লোক আইন না মানলে বা দোষ করলে, তার জন্য দায়ী করা হবে সব লোককে? এটা কি ঠিক?’
এই যুক্তির সামনে দেবার মতো পাল্টা কোন যুক্তি খুঁজে পেলাম না। মিন মিন করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘না মানে সে তো ঠিক আছে, কিন্তু…’
কানাইদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘জোর করে তর্ক করতে যাস না। এটা স্বীকার কর কয়েকটা মানুষের ভুলের জন্য একটা দেশের বা একটা জাতির সব মানুষকে দায়ী করা যায় না। আর এই মনোভাব শুধু আমাদের দেশে বলে নয়, সারা পৃথিবীতে বাড়ছে। দোষ চাপিয়ে দেওয়ার এমন একটা মানসিকতা আমাদের মধ্যে এসে গেছে, যে আমরা নিজেদের দোষগুলো ঢাকার চেষ্টা করছি অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে।‘
আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘আমি এদের সবাইকে দোষ দিচ্ছি না। বিশেষ করে আমার শেষ দু’বছরের অভিজ্ঞতার পর তো আরওই নয়। এখানকার লোকজনকে যেটুকু চিনেছি, তাতে আমার এই কথা বলা উচিৎ না। আসলে চারদিকে লোকে এত কথা বলছে, যে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল মাঝে মাঝে সব গুলিয়ে যাচ্ছে।‘
কানাইদা গম্ভীর ভাবে বলল, ‘তোকে একজন নাম করা বিজ্ঞানীর একটা কথা বলি, ভদ্রলোকের নাম Adam Kucharski, লন্ডনের School of Hygiene & Tropical Medicine এর অধ্যাপক, কাজ করেন সংক্রামক রোগ নিয়ে। তাঁর লেখা একটা বইতে উনি লিখছেন, ‘ইতিহাস সাক্ষী যে প্যান্ডেমিক মানুষ হওয়ার যে পরিচয়, সেই মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে, মানুষের ভেতর যে হীন মনোবৃত্তি গুলো লুকিয়ে থাকে, এই সময় সেগুলো প্রকাশ পায়। তাই এই সময় সব থেকে বেশী দরকার সেই জিনিসগুলোর যত্ন নেওয়া। কোন কারণে মনে খটকা লাগলে, কোন প্রশ্নের উত্তর না পেলে, পরামর্শ করো তাদের সাথে যারা জানে, সব সময় উত্তর খোঁজো প্রমাণের মধ্যে, সত্যি ঘটনার মধ্যে।‘ আর আমরা কি করছি, কিছু বাজে গুজবে বিশ্বাস করে এক শ্রেণীর লোকের ওপর দোষ চাপাচ্ছি। তুই জানিস, কদিন আগে আমেরিকায় একটা গুজব রটেছিল, যে কালো লোকেরা করোনা আক্রান্ত হয় না। লোকের বিশ্বাসে কিছুদিনের মধ্যে সেটা বেড়ে দাঁড়াল, কালো লোকেরা যেমন হয় না, এশিয়ানরা তেমনি বেশী করে হয়। ভাবিস না, এই গুজব মানুষ ভুলে গেছে বা অবিশ্বাস করেছে। পৃথিবী জুড়ে এশিয়ানদের ওপর, বিশেষত চাইনিজদের সাথে বৈষম্যমূলক ব্যবহার বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। হাতের সামনে চীনকে পাচ্ছো না, দেখতে কিছুটা এক রকম নর্থ-ইস্ট এর লোকজন তো রয়েছে, তাদের ওপর জুলুম করো, এই জিনিস ঘটছে আমার দেশে। ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমাকে বলতো, এখানকার যে ছেলে মেয়েগুলো বাইরের দেশে পড়াশুনো করতো, চাকরি করতো, তাদের কি দোষ? যারা বাড়ি এসেছিল নতুন বছরের ছুটিতে, তারা আর ভয়ে ফিরতে চাইছে না আমেরিকা বা ইউরোপ এর ইউনিভার্সিটি গুলোতে, এই ভয় বা কেরিয়ারের এই ক্ষতি কি সত্যি এদের প্রাপ্য? একবার ভাবতো, আমাদের এই ইউনিভার্সিটি তে পৃথিবীর কত দেশের স্টুডেন্ট আছে, কদিন পর যদি তারা কেউ না থাকে, কেমন লাগবে? আমাদের সবার জীবনে যে রকম বৈচিত্র্য দরকার, আমাদের চারপাশের পরিবেশটাও যদি বৈচিত্র্যময় না হয়, তাহলে কতটা ক্ষতি ভাবতে পারছিস? আর কিছু অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা, যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ব্রাজিল এর মত দেশগুলোর, তারা লাগাতার বলে চলেছে, চাইনিজ ভাইরাস, চীনের দোষ। এদের চিৎকারে চাপা পরে যাচ্ছে পৃথিবীর শিক্ষিত লোকগুলোর কথা, যারা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ভাইরাসের কোন দেশ হয় না, মানুষের গায়ের রঙ বা মুখের গড়ন দেখে ভাইরাস আক্রমণ করে না, সব মানুষ একই রকম ভাবে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু, এদের কথা শুনছে কে? ঠিক যে সময় একসাথে গবেষণা করে এই ক্রাইসিসের হাত থেকে বেরোনোর রাস্তা খোঁজা দরকার, সেই সময় এই বিভাজন কি সত্যি আমাদের ভালো করবে? জানি না, উত্তর দেবে কিন্তু সময় আর আগামী দিনে মানুষের মানসিকতা’।
কথা বলতে বলতে বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি, ঢোকার মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কানাইদা, এই যে এতক্ষণ কথা হলো তোমার সাথে, ভাবছি এগুলো এক জায়গায় লিখে আমার ওয়েব পেজে তুলে দিলে কেমন হয়।‘
কানাইদা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘কেন?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না মানে, আমি তো আজকে কত নতুন কিছু জানলাম, তাই আরও বেশী করে লিখতে ইচ্ছে করছে। যদিও জানি না কতজন পড়বে, বা যারা পড়বে, তাদের মধ্যে কে কি বলবে আমাকে।‘ ‘
কানাইদা মজা পেয়েছে বলে মনে হল, ‘কি বলবে বলে তোর মনে হয়?’
আমি বললাম, ‘না, একটু আলাদা কথা বললেই তো আজকাল লোকে আরও উল্টোপাল্টা কথা বলে, তাই আর কি।‘
কানাইদা হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার এটাতে খুব সুবিধে হয়, জানিস। কারুর সাথে কথা বলছি, তর্ক হচ্ছে, হতে হতে যেই অন্য লোকটা এই স্টেজে চলে আসে, আমি বুঝে যাই, এর সাথে আর কথা বলে লাভ নেই। এর আর নতুন কিছু বলার নেই, এবার জোর করে তর্ক করবে, করতে হবে বলে। আমি রণে ভঙ্গ দিই। আর ক’জন পড়বে সেটা ভাবিস না। একজন হলেও তো পড়বে, আর কেউ না হোক, তোর বাড়ির লোক তো পড়বে। তারা তো নতুন করে ভাবার একটা চান্স পাবে। এরপর যখন তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা হবে, তাদের তো আর শুধু শ্রোতা হয়ে থাকতে হবে না। তোর সাথে আজকে কথা বলে যেমন কয়েকটা হলেও তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি, কয়েকটা বস্তাপচা ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিতে পেরেছি, তেমনি তোর লেখা পড়ে যদি একজনও একটু অন্য ভাবে ভাবে, চলতি ধ্যানধারণা গুলোকে প্রশ্ন করতে পারে, তাহলেই হবে।‘
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কানাইদা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তাই আমি বলবো, লেখ। তবে এটা ভেবে লিখিস না, যে তোর লেখা যারা পড়বে, তারা সবাই একমত হবে। প্রশ্ন উঠবে অনেক। সেটাই দরকার। প্রশ্ন না করে কোন কিছু মেনে নেওয়াটা মুর্খামি। সবাই যা বলছে, যা করছে, সেটা যে ঠিক তার কোন মানে নেই। এই যে তোকে আজ এত কথা বললাম, আমি তো ভুলও বলতে পারি বেশ কিছু, হয়তো জানি না কিছু জিনিস। কিন্তু আমি জানতে চাই। আজ যদি কেউ আমাকে এসে বলে, না ভাই, এটা তুমি ভুল বলেছো, আমি চুপ করে শুনবো, তারপর নিজে ঘেঁটে দেখবো, পড়াশুনো করবো, তারপর মানবো। তাই, নিজে বিচার করাটা খুব দরকার, বিশেষ করে আজকের দিনে। তর্ক কর, ওটা ভালো। কিন্তু এঁড়ে তর্ক না, তার যেন ভিত্তি থাকে। ভুল স্বীকার করাটাও যেমন দরকার, তেমনি এটাও বোঝা দরকার – ও করলেও যেটা ভুল, আমি করলেও সেটা ভুল। ভুলটা মানুষ বা জাতি বা দেশ বিচার করে আলাদা হয় না। এই ভাইরাসের মতন, বরং বলতে পারিস, তার থেকেও বেশী ক্ষতিকর। দেখ, আজকের বিজ্ঞানের যে প্রগ্রেস, তাতে আজ না হোক কাল, মানুষ ঠিকই এর ভ্যাক্সিন বের করবে, রোগটাও সেরে যাবে। কিন্তু থেকে যাবে কোন জিনিসটা জানিস? মানুষের মনের এই অন্ধকারটা, একে অপরকে অবিশ্বাস করার এই প্রবণতাটা, আঙ্গুল তোলার অভ্যেসটা। বিজ্ঞান পারে এই জিনিসকেও দূর করতে, কিন্তু তার জন্য তো মানুষকে চেষ্টাটা করতে হবে নিজেকে পাল্টানোর। মানুষ যদি নিজে চোখ বন্ধ করে থাকে, দেখতে জানতে শুনতে না চায়, তাহলে মনের এই মহামারী আটকাবে কোন বিজ্ঞান?’
এবার হাতের ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই আঁতকে উঠে কানাইদা বলল, ‘দেখেছিস, কতো দেরী হয়ে গেলো। আমি এবার চলি, তুইও ঘরে গিয়ে রান্না কর।বড্ড দেরী করিয়ে দিলাম রে তোর।‘ বলেই উল্টো দিকে ফিরে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো।
আমি ভদ্রতার খাতিরে বলতে গেলাম, দেরী আর কোথায় হল, এই তো সবে দুটো বাজে, আর বলা হল না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ঠিক করে ফেললাম, আজকের এই শেষ এক ঘণ্টার ব্যাপারটা লিখে ফেলতে হবে। একসাথে অনেকগুলো জিনিস জড় হয়ে গেছে, গুলিয়ে যাওয়ার আগে চটপট লিখে না রাখলে ভুলে যাবো। তারপর লিখতে গেলে কিছু বাদ গেলে, আর কানাইদা কোনোদিন সেটা পড়লে, আমাকে আর আস্ত রাখবে না।