top of page
ছেড়ে যেতে পারিনি

জানুয়ারী ৬, সোমবার, রাত ৮ টা

আজ বাড়ি থেকে ফিরেছি। কাল সারা রাত  জার্নি করে শরীর আজকে আর দিচ্ছে না। সারা দুপুর ঘুমিয়েও ক্লান্তি কাটছে না এখনও। কাল অফিস যাব। যদিও আজ সকালে ফিরে অফিস জয়েন করার কথা ছিল, কারণ আমার ছুটি নেওয়া ছিল গতকাল রবিবার অবধি। আজকে যাওয়াটা দরকার ছিল, আমার গ্রিন হাউসের গাছগুলোর আজ পরিচর্যা করার দিন। কিন্তু ফিরে বুঝলাম আজ যাওয়া সম্ভব নয়। বসকে জানাতে বললেন, ‘আজ ভালো করে রেস্ট নাও, আমি স্টুডেন্টদের বলে দিচ্ছি, ওরা রিডিং নেবে। তুমি কাল থেকেই জয়েন করো’। তাই ঘুমিয়ে কাটালাম আজকের বেশীর ভাগ সময়, আবার ঘুম পাচ্ছে। রাতের খাবার অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি, এবার খেয়ে সোজা বিছানায়। মনটা ভালো লাগছে না, আবার কবে বাড়ি যাব জানি না। যদিও বলে এসেছি, জুন মাসে একবার আসবো, দেখা যাক – চলেই যাব ওই সময়।

জানুয়ারী ১৭, শুক্রবার, রাত ৯ টা

একবছর আগের কথা মনে পড়েছে আজ সারাদিন ধরে। আজ এখানে নতুন বছরের শুরু, যদিও নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন হবে পঁচিশে জানুয়ারি। গত বছর চাইনিজ নিউ ইয়ার শুরু হয়েছিল ৫ ই ফেব্রুয়ারি থেকে, আবার পরের বছর শুরু হবে ১২ ই ফেব্রুয়ারী থেকে। আমাদের পুরো ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ফাঁকা, সবাই বাড়ি চলে গেছে। আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম, এই সময়ে বাড়ি যাব, এক মাস ছুটি পাওয়া যাবে। কিন্তু কি মনে করে আগেই চলে গেছিলাম। কিন্তু এখন আসতে আসতে সব বন্ধ হবে, যেমন এই সপ্তাহ শেষ হবে আর তারপরেই সুপার মার্কেট, ক্যান্টিন সব বন্ধ থাকবে আগামী দু-সপ্তাহের জন্য। ক্যান্টিন বন্ধ মানে আমার রান্না করা শুরু বাড়িতে। আগের বছর এই সময় খুব মজা হয়েছিল, চি এসেছিল ৫ ই ফেব্রুয়ারি, আর তারপর রোজ ভালো ভালো খাওয়া, দুপুরে লম্বা ঘুম, সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেরনো বা বাসে করে এদিক ওদিক ঘুরে আসা, আর রাতে সিনেমা দেখা – এই ছিল রুটিন। এবারে আমি একা, তাই ঠিক করেছি রোজ অফিস যাব, দুপুরে বাড়ি এসে রান্না করব। বিকেলে বাড়ি থেকে কাজ করব, দেখা যাক।

জানুয়ারী ২৫, শনিবার, রাত ৮ টা

আজ বিচ্ছিরি ব্যাপার। এই সপ্তাহে রোজ রান্না করেছি। আহামরি কিছু না – ভাত, ঘি, আলুসেদ্ধ, ডিম এই সব। আজকে ঠিক করেছিলাম যে রান্না করব না। কালকের করা ডিমের তরকারিটা আজকে দুপুরে খেয়ে নেব, আর বিকেলে বাইরে যাব, পিৎজা নিয়ে আসব রাতের জন্য।

আমাদের ইউনিভার্সিটির চার দিকে চারটে গেট আছে- বাইরের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য। দিক হিসেবে তাদের নাম - নর্থ গেট, ইস্ট গেট, ওয়েস্ট গেট আর সাউথ গেট। এই চারটে গেট ছাড়াও আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে একটা ছোট গেট আছে, যেটার নাম লিটল নর্থ গেট। বাজারে যেতে হলে আমি এই গেট টাই ব্যবহার করি। তো আজকেও সেই গেট দিয়েই বাইরে বেরলাম। গেটের বাইরে একটা সরু রাস্তা যার দুপাশে কিছু খাবার দোকান, জেরক্সের দোকান, সেলুন – এই সব আছে। আগের বারের মত এবারো এই ছোট দোকানগুলো সব বন্ধ, কারণ এগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের ওপর, তাই ইউনিভার্সিটিতে ছুটি মানে এই দোকান গুলোও বন্ধ থাকে। অবাক না হয়ে বাইরে বাজারে আসতেই কিন্তু অস্বাভাবিকত্বটা চোখে পড়ল। রাস্তায় কোন লোকজন নেই, একটাও দোকান খোলা নেই। গত বারের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, লোকে আজকের দিনে বাইরে খেতে যায়, পার্টিতে যায়, রাস্তায় লোকের ভিড়ে হাঁটা মুশকিল হয়। এবারে রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি একটা কি দুটোর বেশী চোখেই পড়ল না, বাস চলছে কিন্তু তাতে প্যাসেঞ্জার নেই বললেই চলে।  মনে পড়ল, কদিন আগে খবরে পড়েছিলাম, একটা ভাইরাস আউট ব্রেক হয়েছে, মধ্য চীনের উহান শহরে। কিন্তু সেতো এখান থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে। দিন চারেক আগেই নি জিজ্ঞাসা করছিল, ‘তোদের ওখানে একটা জ্বর হচ্ছে শুনলাম, কি ব্যাপার?’ আমিও শুনেছিলাম, বললাম, ‘হ্যাঁ, উহান শহর থেকে কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছে, আমাদের এখানে তো এখনও কিছু শুনিনি সেই ভাবে।’ নি বলল, ‘এখানে কলকাতা এয়ারপোর্টে টেম্পারেচর চেক হচ্ছে’। খবরের কাগজ তো এখানে পাই না, পেলেও বুঝতে পারি না, কারণ সবই চাইনিজ লেখা। আমার কাছে খবর বলতে তাই মোবাইল অ্যাপই ভরসা। নি কে বলতে, ও আমাকে Times of India র রিপোর্টটা পাঠিয়েছিল, সেখানেই বিস্তারিত জেনেছিলাম। এখানেও কি তার প্রভাব পড়ল নাকি? কি আর করবো, খালি হাতে বাড়ি ফিরলাম একটু আগে, রাতে আবার কি রান্না করব সেই ভাবতে ভাবতে। যদি সত্যি এখানেও সেই ভাইরাস এসে থাকে, তাহলে তো চাপের ব্যাপার।

জানুয়ারী ২৬, রবিবার, দুপুর ৩ টে

 

আজ সকাল থেকে পুরনো খবরগুলো ঘেঁটেছি, ইউনিভার্সিটি থেকে আসা ইমেইল গুলো ট্রান্সলেট করেছি সব কটা। গতিক খুব একটা সুবিধের নয় বলেই মনে হচ্ছে। ২৩ তারিখ থেকে উহান শহর পুরো লকডাউন, যার মানে শহর থেকে না তো কেউ বাইরে যেতে পারবে, না তো কেউ আসতে পারবে। শুধু তাই নয়, সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিন ছাড়া লোকজনের বাইরে বেরোনোর অনুমুতি নেই। বাজারহাট, দোকানপত্তর, অফিস স্কুল কলেজ সব বন্ধ, আর সেটাও অনির্দিষ্টকালের জন্য। উহান শহরের একটা মাংস বিক্রির মার্কেট থেকে এই ভাইরাস নাকি ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও কোন প্রাণীর মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে ঢুকেছে তা এখনও নিশ্চিত নয়, তবে ধারণা বাদুড় বা প্যাঙ্গলিন নামে এক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমে। সব থেকে যেটা চাপের সেটা হল, সাধারণ জ্বরের সাথে এই অসুখের লক্ষণ এক, তাই উপযুক্ত পরীক্ষা না করলে এই ভাইরাস এর উপস্থিতি ধরা যাচ্ছে না। সাধারণ ওষুধে যখন জ্বর কমছে না, তখন লোকে রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছে, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে হাঁচি, কাশির মাধ্যমে। অলরেডি মানুষ মরতে শুরু করেছে। তাই আরও ক্ষতি হবার আগে যেখান থেকে উৎপত্তি, সেই উহান শহর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। কিছু রিপোর্ট বলছে, এই লক্ষণ প্রথম দেখা গেছিলো গত নভেম্বর মাসে। ডিসেম্বর মাসে সেটা সংখ্যায় কিছুটা বাড়ে, আর তারপরই চলে আসে নিউ ইয়ার। লোকজনের যাতায়াত শুরু হয় পুরো দেশ জুড়ে, এমনকি বিদেশেও। কারণ বছরের এই সময়টা এদের কাছে সবথকে আনন্দের, দূরে থাকা মানুষ জন বাড়ি ফেরে এই সময়, বছরে একবার হয়তো। আর এই সুযোগেই ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে, তবে কতদূর সেটা বোঝা যাচ্ছে না। যদিও WHO এখনও এই পরিস্থিতিকে এপিডেমিক বলে ঘোষণা করেনি, তবে যা গতিপ্রকৃতি ঘটনার, সেই দিন আর বেশী দূরে নয় বলেই মনে হচ্ছে।

যখন পি এইচ ডি করতাম, দেখতাম চীনের বিজ্ঞানীরা মলিকুলার গবেষণায় সিদ্ধহস্ত, এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১২ তারিখে এই ভাইরাসের জিনের সিকুয়েন্স তৈরি হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করেছেন এই সিকুয়েন্সের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষেধক আবিষ্কারের। সেই রিপোর্টের প্রথম দিকের কয়েকটা প্যারাগ্রাফ পড়ে যা বুঝলাম টা হল এই - মাইক্রোস্কোপের তলায় দেখলে এই ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো কিছু অংশ দেখা যায়, যাদের ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় করোনা, আর তাই এই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছে করোনা ভাইরাস। যদিও করোনা পরিবারে আরও ভাইরাস আছে, তাদের মধ্যে কিছু সদস্য মানুষের শরীরে সামান্য জ্বর-সরদিকাশি ছাড়া কিছু করে না, কিছু আবার অন্য প্রাণী দেহে আক্রমণ করে। এই সব সদস্যের কয়েকটা বিবর্তন ঘটিয়ে আরও ক্ষতিকারক রুপে মানুষের দেহে ঢোকে, যেমন হয়েছিল MERS, SARS এর বেলায়। এই ভাইরাসটাও সেরকম – আর তাই এর নাম SARS-CoV2। আর স্বাভাবিক ভাবেই, কিছু লোক নাম দিয়েছে চাইনিজ ভাইরাস – ঠিক যেভাবে ১৯১৮-১৯ সালে স্পেনে H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কে আজও লোকে ডাকে স্প্যানিশ ফ্লু বলে, যদিও সেই ভাইরাস না তো উৎপত্তি হয়েছিল স্পেনে, না তো সেখান থেকে ছড়িয়েছিল। সাধারণ লোকের মুখে বা দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে এই জিনিস মানায় – কিন্তু যখন আমার প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের  কাছ থেকেও এই নাম শুনি, তখন অবাক লাগে বৈকি। কালই একটা ইমেইল পেয়েছি এরকম – ‘Dear Achyut, I hope you are well. With news about the Chinese virus spreading, I thought of checking out with you. Please take all necessary precautions. Best Wishes…’।

   

ইউনিভার্সিটির ইমেইল বলছে - ছুটি বাড়ানো হয়েছে, কবে অফিস খুলবে জানা নেই। যে সব স্টুডেন্টরা ছুটিতে বাড়ি গেছে, তাদের ফেরত আসতে বারণ করা হয়েছে। যারা রয়েছে আমার মতো, তাদের খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। আর রয়েছে কি ভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার নিয়মাবলী। হাত ধোয়া সাবান বা অ্যালকোহল দিয়ে, মুখে মাস্ক বাঁধা, প্রচুর জল খাওয়া এই সব। জানানো হয়েছে, সব গেটে থাকছে শরীর চেক আপের ব্যবস্থা, ঢোকা বেরোনার সময় যা করানো বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, যে কোন সময় বাড়িতে চেক আপ করতে আসতে পারে, সেই ডাক্তারদের সাথে সব রকম সহযোগিতা করার কথাও বলা হয়েছে।  শেষ এক সপ্তাহে এই সব ইমেইল এসেছে, আর তার সাথে রোজ এসেছে মোবাইল সার্ভিস ম্যাসেজ। সবই সরকারী উদ্যোগে, যেখানে বলা হয়েছে কি কি করা দরকার, আর কি কি করা যাবে না – যেমন কোনোরকম পাবলিক গ্যাদারিং, অনুষ্ঠান সব বন্ধ করা হয়েছে দেশ জুড়ে, গুয়াংঝৌও তার ব্যাতিক্রম নয়। এবার বুঝলাম কেন কাল রাতে সব বন্ধ ছিল বাইরে।

কাল অফিস যাব ঠিক করেছি, ল্যাবে মাস্ক রাখা আছে, সেগুলো কয়েকটা নিয়ে আসবো। আমাকে বাইরে বেরোতে হবে কদিন পরেই, খাবারের স্টক ফুরিয়ে আসছে, সুপারমার্কেটটাও খুলবে বলে মনে হয় না। অবশ্য বাইরের দোকান কিছু খোলা পাবো কিনা জানি না। দেখি, আর একটা সপ্তাহ, তারপর ক্যান্টিনটা অন্তত খুলবে বলে মনে হয়, রোজকার খাবারের চিন্তাটা যাবে।

 

জানুয়ারী ৩১, শুক্রবার, বিকেল ৬ টা

 

আজ অফিস যাইনি, বাড়িতেই ছিলাম। সকালে পড়লাম যে গতকাল WHO এটাকে গ্লোবাল এমারজেন্সি বলে ঘোষণা করেছে। প্রায় ছয় হাজার লোক আক্রান্ত, আর ১০০ জনেরও বেশী মারা গেছে। চীন ছাড়াও পৃথিবীর আরও অনেক দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। থাইল্যান্ড, জাপান, সাউথ কোরিয়া, উত্তর আমেরিকা, ভিয়েতনাম, নেপাল, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, জার্মানি – এরকম প্রচুর দেশ থেকে খবর আসছে। কাল ইন্ডিয়াতেও একজনকে পজিটিভ পাওয়া গেছে, কেরালায়। সে উহানে পড়াশুনো করতো, নতুন বছরের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। যেহেতু উহান বন্ধ, তাই অনেক দেশ তাদের সিটিজেনদের উদ্ধার করে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ প্লেন পাঠাচ্ছে, ইন্ডিয়াও কাল উহান থেকে সমস্ত ভারতীয়দের দেশে ফেরত নিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বারবার বলছে – ফেরত যাবার জন্য। এখনও প্লেন চলছে দুই দেশের মধ্যে, কবে বন্ধ হয়ে যায় ঠিক নেই। অনেক দেশ আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে চীনের সাথে। তাই গেলে এখনই যেতে হয়, কিন্তু কি করব বুঝতে পারছি না। আজকে বসের সাথে দেখা হল, উনি চলে এসেছেন বাড়ি থেকে। আমি জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না, ‘এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন বাড়ি থেকে?’ উনি বললেন, ‘এর পর যদি আসতে না পারি, অনেক কাজ পড়ে রয়েছে এখানে। আজ উহান বন্ধ হয়েছে, কাল যদি গুয়াংঝৌ বন্ধ হয়ে যায়? তখন তো আর আসতে পারবো না। যদিও গুয়াংঝৌ এর পরিস্থিতি এখনও অতটা খারাপ নয়, তবুও বলা যায় না। তাছাড়া, তুমি এখানে একলা, সাবধানে থাকো, খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে বেরিও না। আর যদি কখনও কোন কিছুর দরকার হয়, আমাকে বলবে।’

তাই আজ জল শেষ হয়ে যাবার কথাটা ওনাকে না বলে পারলাম না। খাবার জল শেষ হয়ে গেছে বাড়িতে। আমাদের এখানে জল কিনে খেতে হয়, অর্ডার দিতে হয় ফোনে, লোক এসে দুটো ১৫ লিটারের জার দিয়ে যায়। সেই দুটো জারে আমার দু সপ্তাহ চলে যায়। কিন্তু এবার ফোনে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইউনিভার্সিটিতে ছুটি চললেও, এই এসেনশিয়াল পরিষেবাগুলো চালু থাকে, কিন্তু এবার কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। অফিসেও একই অবস্থা। তাই একটা কেটলি অর্ডার করেছিলাম, সেটা গত পরশু এসে পৌঁছেছে, অফিসে সেটা দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। বাড়িতেও তাই করতে হবে, কফি করার কেটলিতে রান্না ঘরের কলের জল ফুটিয়ে খাই কদিন, দেখা যাক কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একটাই সমস্যা এই ভাবে জল খাওয়ার – গরম জল ঠাণ্ডা হতে অনেক সময় নেয়। যদিও এখন খুব ঠাণ্ডা বলে জল অল্প ঠাণ্ডা হলেই খেয়ে নেওয়া যাচ্ছে। দোকান থেকেও খাবার জল কিনে আনতে পারি, দেখি তাই করতে হবে হয়তো কয়েকদিন পর।

8.JPG

আমার রুমের ব্যালকনি থেকে তোলা

1.jpg

ইউনিভার্সিটির ভেতরে

2.jpg

মেইন অফিস বিল্ডিং

ফেব্রুয়ারী ৪, মঙ্গলবার, রাত সাড়ে ৮ টা

আজ থেকে বোধ হয় বাইরের লোকজনের ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা বন্ধ হল। বাইরের লোক বলতে ফুড ডেলিভারি বয়, অনলাইন অর্ডার সাপ্লাই বয় – এদের কথা বলছি। আজকে রাতে খাবার অর্ডার দিয়েছিলাম। মোবাইল অ্যাপ যদিও চাইনিজে পুরোটা, কিন্তু আমি খাবারের ছবি দেখে অর্ডার করি। কিছু ডিশ ঠিক করে রেখেছি আর তার সাথে কিছু দোকান – অ্যাপ খুলে সেখান থেকেই আমি অর্ডার করতে পারি। প্রথম যখন অ্যাপটা ইন্সটল করেছিলাম, তখন ট্রান্সলেট করে করে নিজের বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে রেখেছিলাম, সেটাতেই খাবার আসে। যদি ডেলিভারি বয় দোতলায় আমার ফ্ল্যাট অবধি না এসে তলা থেকে ফোন করে, আমি ধরি না – কারণ সে কি বলবে আমি বুঝব না, আমি কি বলতে চাই সে বুঝবে না। তখন আমি তাকে চাইনিজে ম্যাসেজ করি – ইংরাজিতে লিখে সেটাকে ট্রান্সলেট করে, কপি-পেস্ট করে পাঠাই। আজ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে বহুবার কাজ হয়েছে। কিন্তু আজ হল না। সে আর খাবার নিয়ে আসে না, ২০ মিনিট চেষ্টার পর বাধ্য হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করলাম। তার একটু পরে দোকান থেকে টেক্সট – এবার ইংরাজিতে। খুব বিনীত ভাবে জানাচ্ছে – ইউনিভার্সিটির ভেতর ঢুকতে না দেওয়ার জন্য ডেলিভারি বয় গেটের বাইরে আমার জন্য খাবার নিয়ে গত আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে, খুব ভালো হয় যদি আমি গেট অবধি গিয়ে খাবারটা নিয়ে আসতে পারি। বেরলাম সাইকেল নিয়ে, গেলাম লিটল নর্থ গেটে। গেটের এদিকে সিকিরুটি ছাড়া আর কোন লোক দেখতে পেলাম না, আর ওদিকে একটা বাচ্চা ছেলে – যদিও এদের বয়স আন্দাজ করা খুব কঠিন – তাও মনে হল আঠারো এর বেশী না, হাতে খাবারের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আধো অন্ধকারে মশার কামড়ে, ছেলেটা কে অতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে খুব খারাপ লাগছিল নিজের। কিন্তু যার বিরক্ত হওয়া উচিত ছিল, অবাক হয়ে দেখলাম সে হাসি মুখে আমার হাতে খাবারটা দিয়ে কিছু একটা বলল, ভালো বুঝলাম না – অবশ্য আমার সরি বা থ্যাঙ্ক-উ টাও সে নিশ্চয় বুঝতে পারেনি। তবে না বুঝলেও তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপটা স্পষ্ট। অবশ্য আনন্দটা কার বেশী হওয়া উচিৎ - রাতে রান্না করতে হবে না বলে আমার, নাকি আধঘণ্টার অপেক্ষার পর সাফল্যের জন্য ছেলেটার, সেটাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম এই ১০ মিনিট হল। এর আগেও দেশে এরকম পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়েছি, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার সাথে আজকের অভিজ্ঞতাটা মিলছে না।

একটু পরে খেতে বসব। আজকে খেয়ে নিই বাইরের খাবার, যদিও আহামরি কিছুই না – ভাত, একটা সবজি, আলু-মাংসের একটা ঝোল, এরপর থেকে এটাও বন্ধ হতে চলেছে। কারণ যা বুঝলাম এবার থেকে বাইরের লোকের ঢোকা বন্ধ হল। মারাত্মক রকমের কড়াকড়ি চলছে এখানে, ভিডিও দেখছি কি ভাবে রাস্তায় রাস্তায় চেকিং চলছে পথচলতি লোকের ওপর। রোজ ম্যাসেজ পাচ্ছি শরীর খারাপ হলেই লুকিয়ে না রেখে কাছাকাছির হসপিটালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে। আজ একটা লিস্ট পেয়েছি গুয়াংডং প্রদেশের হসপিটালের যেখানে এই ভাইরাস ঘটিত রোগের চিকিৎসা হবে, তার মধ্যে আমাদের ইউনিভার্সিটির হসপিটালটাও আছে দেখেছি। ভালোই হল, সেরকম বুঝলে সোজা ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব হসপিটালে। উহান শহরে দুটো গোটা হাসপাতাল তৈরি হয়েছে এই রোগের চিকিৎসার জন্য – গত ২৩ শে জানুয়ারী কাজ শুরু হয়েছিল, আর আজকে পড়লাম প্রথম পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে, মানে হাসপাতাল চালু হল মাত্র ১০ দিনের মাথায়। খবরে পড়লাম, সারা দেশ থেকে কর্মী, ডাক্তার, নার্সদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওই শহরে। WHO নামকরণ করেছে ভাইরাসটার - SARS-CoV2 আর রোগ টার নাম দিয়েছে COVID-19। CO হল Corona, VI হল Virus, আর D হচ্ছে Disease। খবরে পড়লাম, ইন্ডিয়াতে তিনজনের পজিটিভ পাওয়া গেছে – সবাই উহান ফেরত।

এদিকে খাবার যা স্টক করেছিলাম ঘরে, সব শেষের মুখে। আজও ক্যান্টিন খোলেনি, বাইরে নোটিশ ঝোলানো – অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সুপার মার্কেটও বন্ধ, ২ তারিখ খোলার কথা ছিল। বাড়ি থেকে এবার আসার আগে ডাল, ঘি নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো দিয়েই চলছে, আরও কদিন চলবে। তবে এবার বাইরে বেরোতে হবে, কাঁচা সবজি বাজার করতে হবে। দেখি এই সপ্তাহে একবার বাজারে যাবো ঠিক করেছি। হ্যান্ড-ওয়াশটাও ফুরিয়ে এসেছে, সেটাও কিনতে হবে।

 

ফেব্রুয়ারী ১২, বুধবার, সকাল ১১ টা

অফিসে বসে ডায়েরি লিখছি। একটা পেপার জমা দেবার ছিল, সেটা করে নতুন কাজে হাত দেবার আগে ভাবলাম আজকের সকালের ঘটনাটা লিখে ফেলি। আজকে বাজারে গেছিলাম সকালে। গত শনিবার সন্ধ্যেবেলা বাজারে গিয়েছিলাম, কিচ্ছু পাইনি, শুধু আলু আর টমেটো ছাড়া। সেদিন ছিল লন্ঠন উৎসব এর দিন। এই দিনে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন শেষ হয় - চারপাশ আলোয়, মোমবাতিতে সাজানো হয়, আকাশে ফানুস ওড়ে। লোকজন তাদের পরিবারের সাথে খাওয়া দাওয়া, মজা ফুর্তি করে। দিন ফুরোলে আবার এক বছরের অপেক্ষা নিয়ে সবাই নিজের কর্মস্থলে ফেরে। আগের বছর এই দিনে আমি আর চি ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, গেছিলাম বিজনেস ডিসট্রিক্টে। চারপাশে আলোয় সাজানো সেই এক বছর আগের দিন টার সাথে আজকের দিনটার কত তফাৎ। রাস্তার আলো ছাড়া আর কোন আলো চোখে পড়ল না, বাড়ির বারান্দাগুলো সব অন্ধকার, রেস্তোরাঁ গুলো সব বন্ধ। হঠাত দেখলে মনে হয়, যেন পুরো শহরটা কোন এক অজানা আতঙ্কে ঘর বন্দী হয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। কদাচিৎ যে দু-একজন লোক চোখে পড়ে, তাদের দ্রুত পদচারণা বুঝিয়ে দেয় তারাও ওই বন্ধ দরজার পেছনে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদে ফিরতে চায়। আজ সেখানে আনন্দের প্রবেশাধিকার নেই, অন্যবারের মতো এই রাতটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার ব্যাকুলতা নেই, রয়েছে শুধু অপেক্ষা –এই রাত শেষ হবার।

 

তাই আজ সকাল সকাল গেছিলাম। বাড়ির সামনে ছোট গেটটা বন্ধ করে দিয়েছে গত সপ্তাহ থেকেই, তাই মেন গেট দিয়েই বেরোতে হল। এই পরিস্থিতি হবার পর থেকে এই প্রথম আমি শহরের দিকে পা রাখলাম। আগে যখনই বেরিয়েছি, নদীর দিকে বেরিয়েছি। বাইরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। সব দোকান বন্ধ, শুধু ওষুধের দোকান ছাড়া। রাস্তায় লোক হাতে গোনা যায়। গাড়ি এত কম যে চোখ বন্ধ করে রাস্তা পেরনো যায়। সকালের কর্মব্যস্ততায় যে এলাকাটা মুখর হয়ে থাকতো, আজ সেখানে এক অদ্ভুত নীরবতা। বাজারেও সেই একই অবস্থা, অত বড় বাজারে একটাই সব্জির দোকান খোলা। সেখানে গুটি কয়েক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভিড় ছাড়া পুরো বাজার বন্ধ। লক ডাউন ছাড়াই এই অবস্থা – তাহলে উহানের মতো হলে কি হতো? সবজি যা পেলাম, তাই কিনে নিয়েই ফেরার পথ ধরলাম। বাজারের মধ্যে একটা সুপার মার্কেট আছে – সেটা এখনও খোলেনি, তাই হ্যান্ড-ওয়াশটা পেলাম না। মেডিকেল শপেও একবার খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু নেই, সব শেষ হয়ে গেছে। অফিসের অ্যালকোহল দিয়ে বানিয়ে নেব, ওটা নিয়ে চাপ নেই। যে গেট দিয়ে বেরিয়েছিলাম, সেটা দিয়ে না ঢুকে অন্য দিক দিয়ে ফিরলাম। নর্থ গেট দিয়ে ঢোকার মুখে চেক আপ – আপাদমস্তক ডাক্তারি পোশাকে আবৃত হয়ে চার জন। আই-ডি কার্ড দেখছে দুজন, আর দুজন শরীরের তাপমাত্রা মাপছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে, একবার কপালে, একবার হাতের কব্জিতে। ভয় লাগছে এই বুঝি তাপমাত্রা ৩৭.৩ ডিগ্রি পেরিয়ে গেলো, আর তাহলেই সোজা হাসপাতাল। যাই হোক, সেই সব কিছু হল না, আর আমিও ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

বাইরের শহরটা যেমন ঝিমিয়ে, গেটের ভেতরেও ইউনিভার্সিটি ঘুমিয়ে। সেই সুযোগে গাছের হলুদ শুকনো পাতার স্তূপ অধিকার করেছে কালো পিচের রাস্তার অনেকটা। গেটের বাইরে একদিকে যেমন পৃথিবীর অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট আজ জনশূন্য, অন্যদিকে নদীর পাশের রাস্তা মানুষের সকাল-বিকেলের দৈনিক কসরতের সাক্ষী হতে পারেনি আজ বেশ কয়েকদিন হল। গেটের এপারে আসলে এতদিন একটা অন্যরকম পরিবেশে এসে পড়েছি বলে মনে হতো, বাইরের কোলাহলের সাথে ভেতরের নিস্তব্ধতার– এক অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল। আজ সবই এক রকম। কে যেন গেটের দুপারের আলাদা হয়ে থাকা দুটো পৃথিবীকে ধরে একসাথে মিলিয়ে দিয়েছে, যেন এই সুযোগ সব পার্থক্য মুছে দেবার। বাড়ি থেকে অফিস যাবার দেড় কিলোমিটার রাস্তায় কদাচিৎ মানুষ জনের দেখা মেলে, তারাও সন্ত্রস্ত ভাবে এদিক ওদিক দিয়ে চলে যায়। কেউ কারুর পাশাপাশি হাঁটে না, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলে না। আমার অফিসও পুরো ফাঁকা, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরের ভেতর দরজা আটকে তিন চারটে লোক কাজ করছে হয়তো। কার পারকিং, সাইকেল স্ট্যান্ড – সব ফাঁকা। এত বড় ক্যাম্পাস, আজ মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সেই হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যের স্রোত আর বই-খাতার গন্ধ মাখা ক্লাসরুম।

4.JPG

সব রাস্তাই এরকম ফাঁকা

5.jpg

বসন্ত এখানে বোঝা যায়

11.JPG

গাছ থেকে এখানে ফুল তোলা বারণ

7.jpg

পাখিগুলোর পোয়া বারো

ফেব্রুয়ারী ২৯, শনিবার, বিকেল ৫ টা

 

এর মধ্যে আর ডায়েরি লেখা হয়নি, কারণ লেখার মতো কিছু ঘটেনি। আজ গত দেড় মাস ধরে একই রুটিন চলছে।  রোজ সকালে উঠে কফি খেতে খেতে খবরে চোখ বোলাই, শুধু মানুষের মারা যাবার খবর পড়তে আর ভালো লাগে না। শুধু চীন এই আশি হাজারের ওপর লোক আক্রান্ত, মারা গেছে প্রায় তিন হাজার। বাকি পৃথিবীতে সংখ্যাটা রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যত বড়বড় বিদেশী ব্র্যান্ডের দোকান ছিল এই শহরে, সব বন্ধ রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। গুগল, অ্যাপেল এর সব অফিস, শো-রুম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও একই অবস্থা। রোজ সকালে কানে এয়ার-পড গুঁজে ফাঁকা রাস্তা ধরে অফিস যাই, দুপুর ২ টো অবধি থেকে বাড়ি ফিরি, রান্না করে খেয়ে দেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে আবার বিকেল ৫ টা থেকে কাজ নিয়ে বসি। জলের সমস্যাটা মিটেছে, গত পরশু থেকে জল দিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে এসে। না হলে কলের জল ফুটিয়ে আর খাওয়া যাচ্ছিল না। দুপুর বেলা বাড়ি ফিরে কিছু রান্না করতে ইচ্ছে করে না, তাই বেশিরভাগ দিনই ভাত, ঘি, আলু সেদ্ধ আর ডিম দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সারি। ঘি আর আলু সেদ্ধ খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গেছিলো, তাই এখন ফুলকপি ভাজা আর রাঙ্গা-আলু ভাজা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। শনি-রবিবার কিছু রান্না করার চেষ্টা করি। এর মধ্যে একদিন চানা করেছিলাম, পায়েসটাও করতে শিখেছি মোটামুটি। ডাল করে রাখি দু-দিনের মতো, খিচুড়ি করে নিই মাঝে মধ্যে। রাতে পরোটা আর আলুভাজা। এখন আমি গোল করে লেচি বেলতেও শিখেছি।

তবে রান্না করাটা সমস্যা নয়, আসল চাপটা হয় রাতে বাসন মাজার সময়। গত কদিন এখানে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে, টেম্পারেচার ১০ এর ওপর ওঠেনি, তার ওপর বৃষ্টি, সূর্যের মুখ দেখিনি বেশ কয়েকদিন হল। এই ঠাণ্ডায় বাসন মাজাটা খুব চাপের। কাপড় কাচার সময়ও একই কষ্ট, তার ওপর রোদ নেই বলে জামা কাপড় শুকোতেও চায় না। খুব বিচ্ছিরি পরিস্থিতি। তার মধ্যে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ডাল, ঘি – সবই শেষের মুখে। এখানে একটা ইন্ডিয়ান স্টোর আছে, অর্ডার করা যায় – কিন্তু এখন আসবে না। তাই খুব বাঁচিয়ে খেতে হচ্ছে এই কদিন, জানি না আরও কদিন এরকম চলবে। এর মধ্যে একদিন চাল ফুরিয়ে গেছিলো, সুপার মার্কেট বন্ধ যেখান থেকে আমি চাল কিনি, বাইরের সুপার মার্কেটটা তখনও খোলেনি, তাই দুদিন লুচি, ছাতু-কলা-দুধ, ন্যুডল - এইসব দিয়ে ম্যানেজ করেছি। আজকে চালটা পেয়েছি, তাই বেশ কয়েকদিন পর দুপুরে ভাত খেতে পেরেছি। এসব কথা বাড়িতে বলিনি। শুধু বলেছি যে আজকে আমি আলু-ফুলকপির তরকারি করেছিলাম। যেটুকু ভালো, সেটুকুই বলা যায়। সবাই এত চিন্তায়, তার ওপর এসব বললে আর দেখতে হবে না। রোজ কথা বলার সময় একটা প্রশ্ন অবধারিত ভাবে হয়, ‘তুই/তুমি বাড়ি চলে আসতে পারবি/পারবে না?’। সেই প্রশ্ন-মিশ্রিত দাবি আর আবদার কে আরও জোরাল করার মানে হয় না।

আমি যেতে পারি বাড়ি, ইচ্ছেও করছে খুব। এখানকার সব ইন্ডিয়ানরা বাড়ি চলে গেছে। আমি জানতাম না। বস একদিন বললেন, ‘ইউনিভার্সিটি থেকে রোজ আমার কাছে খবর নিচ্ছে তোমার ব্যাপারে, কেমন আছ তুমি, কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি। কারণ তুমি ছাড়া আর কোন ইন্ডিয়ান নেই, সবাই চলে গেছে। বাকি বিদেশীরাও অল্প কয়েকজনই আছে।’ আমি থ্যাংক – ইয়ু ছাড়া আর কি ই বা বলতে পারি, তার সাথে জুড়ে দিলাম, ‘আসলে বাড়ির লোকজন খুব চিন্তিত।’ উনি বললেন, ‘সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে তাদের চিন্তা করতে বারণ করো। এখানে যাতে তোমার কোন অসুবিধা না হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার আর ইউনিভার্সিটির’। এই বলে আমাকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে গিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠানো মাস্ক আর গ্লাভস গুলো দিলেন আর বললেন, ‘বাইরে বেরোনোর দরকার নেই, আর তাছাড়া বাইরে ওষুধের দোকানে সব সময় মাস্ক পাওয়া জাচ্ছে না, তাই এগুলো ব্যবহার করো।’ আজ ইউনিভার্সিটির আর একটা ইমেইল – আগামী ৬ ই মার্চ অবধি ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। তবে অফিসের কাজকর্ম হচ্ছে, যারা স্থানীয় তারা অফিসে আসছে। জরুরী পরিষেবা গুলো আবার চালু হয়েছে। যেমন আমাদের স্যালারি, মাসের ১৫ তারিখে নিয়ম মতো এই মাসেও হয়েছে। ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, স্যালারি ঠিক ঠাক হবে, তবে বাকি কিছু জিনিষ – যেমন পুরনো ট্র্যাভেল বিল অ্যাডজাস্ট করতে দেরী হবে, কারণ লোক নেই। অবশ্য শুধু আমাদের ইউনিভার্সিটি বলে না, সব অফিসেই একই বন্দোবস্ত। তবে এর মধ্যেও দেখেছি, রেহাই নেই সাফাই কর্মীদের। মুখে মাস্ক বেঁধে, হাতে কাজের সরঞ্জাম নিয়ে তারা সব সময় ব্যস্ত। কেউ ঝাঁট দিচ্ছে, কেউ অফিস পরিষ্কার করছে, কেউ বা দরজা-জানালার হাতল মুছছে। আগে যেখানে আমাদের ফ্ল্যাটের নীচে ডাস্টবিন তিন দিনে একবার পরিষ্কার হতো, এখন দিনে দুবার হচ্ছে। লিফটের ভেতরে-বাইরে ব্লিচিং পাউডার ছড়ান, লিফটের সুইচের প্যানেলে প্লাস্টিক কভার করা, সেগুলো নিয়মিত পাল্টানো-তাদের কাজের বিরাম নেই। সমস্যাটা দিন আনি – দিন খাই লোকে দের, যেমন যারা খাবার ডেলিভারি দিত। বাইরে যখন গেছি, দেখেছি আগে যে সব হোটেলের বাইরে খাবার ডেলিভারি বয়দের সাইকেলের ভিড় লেগে থাকতো, হোটেল খোলা থাকলেও সাইকেল স্ট্যান্ড ফাঁকা। আমাদের ইউনিভার্সিটি র মতো সব এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে খাবার ডেলিভারি র ঢোকা বারণ। বাজারে যারা রোজকার আনাজ-পাতি বিক্রি করতো, তাদেরও একই অবস্থা।

     

তাই যখনই বাড়ি থেকে এই দাবি ওঠে, আমি আমার বসের আশ্বাস বানী শুনিয়ে তাদের নিশ্চিন্ত করি। এটা ঠিক, এখানে যদি আমার শরীর খারাপ হয়, তাহলে ঠিক ঠাক মেডিকেল কেয়ার পাবো বলে মনে হয়। তার ওপর জেনেছি, এই ভাইরাস সংক্রমণ হলে ২১ দিন পর্যন্ত লেগে যেতে পারে শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে, সবার আবার এই লক্ষণ প্রকাশও পায় না। আমি এর মধ্যে বাজারে বেরিয়েছি, অফিস গেছি, এর মধ্যে যদি আমি সংক্রামিত হয়ে গিয়ে থাকি, আর সেই ভাইরাসকে বুকে জড়িয়ে বাড়ি চলে যাই, আর সেখানে গিয়ে ছড়িয়ে ফেলি, তাহলে আরও এক কেলেঙ্কারি। যদিও এই মাসের ৬ তারিখ থেকে ইন্ডিগো তাদের সরাসরি কলকাতা- গুয়াংঝৌ প্লেন বন্ধ করে দিয়েছে, তবুও ব্যাংকক হয়ে আমি থাই এয়ারওয়েজে এখনও কলকাতা ঢুকতে পারি। কিন্তু, ওখানে এখনও শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যাপারে বা কোয়ারানটাইনের কড়াকড়ি বা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই সব মিলিয়ে বাড়ি ফেরার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না এখন।

এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে, সেটাও লিখে রাখা দরকার, না হলে পরে ভুলে যেতে পারি। প্রচুর লোক আমার খোঁজ নিয়েছে, কেউ আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে, কেউ বা বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে। এদের মধ্যে যেমন আত্মীয়-স্বজনরা আছেন, তেমনই আমার বন্ধু-বান্ধব, পুরনো অফিস কলিগরাও যোগাযোগ করেছে। এই সুযোগে এমন কিছু লোক জনের সাথে কথা হয়েছে, যাদের সাথে আমার শেষ কয়েক বছরে কোন কথা হয়নি, নিকট ভবিষ্যৎে হবার কোন আশাও ছিল না। এদের মধ্যে বেশীর ভাগের বক্তব্য আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরি, এমনকি আমার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে দেবারও প্রস্তাব পেয়েছি। যাদের সাথে আমার সরাসরি কথা হয়েছে, তাদেরকে আমি বুঝিয়ে বলেছি কেন আমি ফিরতে চাইছি না।

এর মধ্যে আবার নতুন খবর – কালকে রাতে বাড়িতে কথা বলার সময় জানতে পারলাম। ওখানে নাকি একটা খবর রটেছে যে এই ভাইরাসটা আসলে একটা বায়ো-ওয়েপন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় জৈবিক মারণাস্ত্র। এটা নাকি চীন এর উহান শহরের একটা ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছিল, অসাবধানতাবশত বা ইচ্ছে করে লিক হয়ে গেছে বা করা হয়েছে। আজকে সকালে এসে খবরটার সত্যতা যাচাই করছিলাম। সেই করতে গিয়ে দেখলাম, খবরটার উৎপত্তি ঘটেছে বেশ কিছু ব্লগিং সাইটে, তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে পশ্চিমের কিছু রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য আর সব শেষে একটা বৈজ্ঞানিক পেপারে এই ঘটনার সত্যতা দাবি করা হয়েছে। যদিও সেই পেপারের কোন যাচাই হয়নি, যাকে আমরা scientific peer review বলি, তাও এই খবর লোকে বিশ্বাস করেছে। আমার দেশও তার ব্যতিক্রম নয়,  বরং সেখানে উগ্রতা কিছুটা বেশীই। কদিন আগেই পৃথিবীর ২৭ জন বৈজ্ঞানিক, যাদের কেউই চীন দেশের অধিবাসী নয়, তারা এই গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন, সাথে এও বলেছেন যে আজ পর্যন্ত হওয়া সব পরীক্ষাতেই প্রমাণিত হয়েছে যে এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোন ওয়াইল্ড লাইফ থেকে, মানুষের হাত ধরে নয়। তবে যুক্তি দিয়ে বিচার কজন মানুষ করবে, সেটাই ভাবার।

এবার রান্না করতে যাই, এখানে গোটা মুগ ডাল পাওয়া যায়, সেটাই অনেক দিন আগে আনা ছিল, আজকে বেটে রেখেছি মিক্সিতে। রাতে ডালের পরোটা করব ঠিক করেছি, আশা করি খাওয়ার মতো হবে।

10.JPG

সন্ধ্যে নামবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে

9.JPG

আকাশেও তার লক্ষণ

14.JPG

খাবারের স্টক

15.JPG

রাস্তায় জমেছে শুকনো পাতার স্তূপ

মার্চ ১৩, শুক্রবার, রাত ৯ টা

প্রায় দু মাস হতে চলল, পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সারা পৃথিবীর অবস্থা দিনের পর দিন আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে, গত পরশু, মানে ১১ তারিখ, এটাকে প্যানডেমিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় আর কোন দেশ বাকি নেই, যেখানে এই ভাইরাস পৌঁছয়নি। এই শহরটা আস্তে আস্তে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। গত দু-সপ্তাহে অভ্যেস মত বাইরে গেছি তিন বার, দেখেছি দোকান খুলছে আস্তে আস্তে, বাজার বসছে আবার আগের মত। তবে লোকের মনে ভয় রয়ে গেছে এখনও – কেউ মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোয়নি, কেউ কোন দোকানে ভিড় করেনা। রাস্তায় চেকিং আরও বেড়েছে, সুপার মার্কেটের মত জায়গা গুলোতে ঢোকার সময় আলাদা করে চেকিং হচ্ছে। যেমন শেষ যেদিন বেরিয়েছিলাম, আমার চেকিং হয়েছে অন্তত তিন বার। কপালে থার্মোমিটারটা ধরার আগে বেশ ভয় লাগে, এই বুঝি কিছু ধরা পড়ল, কিন্তু হয়ে যাবার পর বেশ নিশ্চিন্ত লাগে – যাক, এখনও কিছু হয়নি।

এই পরিস্থিতি হবার আগে এখানে ভি পি এন চালিয়ে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ দেখতে পেতাম মাঝে মাঝে, ইউ টিউবও চলত, এখন সব বন্ধ। তাই সময় কাটানোর জন্য কাজ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ আমি একটানা কাজ করতে পারি না, সেই কাজের মাঝখানের সময়টা কাটতে চায় না কিছুতেই। এত বড় ফ্ল্যাটে বড্ড একা লাগে। বিকেলে কাজ করতে বসে হঠাৎ করে যখন খেয়াল হয় বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে, ঘরের আলো গুলো জ্বালানো হয়নি এখনও, তখন চারপাশের অন্ধকার সেই একাকিত্বকে এক ধাক্কায় অনেকটা জোরাল করে তোলে। আলো জ্বালানোর ফাঁকে উঠে এদিক ওদিক একলা ঘুরে বেরাই, কাজের-অকাজের চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে, নিজের সাথে নিজের কথা বলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না, কারুর সাথে কথা বলার জন্য মনটা হাঁফিয়ে ওঠে। বাড়ির কথা বড্ড মনে পড়ে এই সময়টাতে। মাঝে মাঝে মনে হয়, চলে গেলেই ভালো করতাম। কিন্তু সেই ভাবনাকে বেশী প্রশ্রয় দিলে বিপদ। তাই যুক্তি-পাল্টা যুক্তির লড়াইতে মনকে বোঝাই। এর আগে চীনের অধিবাসীদের ইন্ডিয়াতে ঢোকা বন্ধ হয়েছিল গত মাসে, এই মাসে তার সাথে যোগ হয়েছে ইটালি, ইরান, সাউথ কোরিয়া আর জাপান। আমি ভারতীয় হিসেবে যদিও বা ফিরতে পারতাম, চোদ্দ দিন কোয়ারানটাইনেও থেকে যেতে পারতাম, এখান থেকে পালিয়ে যেতে মন চাইছে না। তবে ইন্ডিয়াতে এই ভাইরাস ঢুকে পড়ল কিছু ইটালিয়ানের হাত ধরে। খবরে পড়লাম, ইটালি থেকে আসা কুড়ি জনের একটা ট্যুরিস্ট গ্রুপ আর তাদের ড্রাইভার করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। কিন্তু ধরা পরার আগে তারা এতো জায়গায় গেছে, সেখানে যে কি পরিমাণ সংক্রমণ ছড়িয়েছে, তা সময়ই বলবে। কাল ইন্ডিয়া থেকে প্রথম করোনা ঘটিত মৃত্যুর খবর এসেছে - সৌদি আরব থেকে আসা একজন।

এবার বাড়ির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। আজকে এখনও কথা হয়নি, একবার ফোন করি।

মার্চ ২৯, রবিবার, দুপুর ১ টা

গত দু-সপ্তাহে এখানে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে আর বাইরের দুনিয়াটা পুরো উলটে পালটে গেছে। গত বুধবার খবরে পড়লাম কলকাতায় করোনা ধরা পড়েছে, লন্ডন থেকে ফেরা এক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মীর ছেলের দৌলতে। সে সেখানে পড়াশুনো করে, নামকরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। লন্ডনের অবস্থা খারাপ হতেও তড়িঘড়ি দেশে পালিয়ে আসে ১৫ তারিখ, তারপর যদিও তাকে কোয়ারানটাইনে থাকতে বলা হয়, সে শহরের রাস্তায় বেরিয়ে, লোকজনের সাথে মিশে কাটিয়ে দেয় আরও দুটো দিন। শেষ পর্যন্ত একরকম জোর করেই যখন তাকে ১৭ তারিখ বেলেঘাটা হসপিটালে চেক করানো হয়, তখন সে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। কিন্তু এর মধ্যে যে আরও কত জনের ক্ষতি সে করে ফেলেছে, সে বোধ যদি তার থাকতো। তাই যখন শুনলাম এই মাসের ২২ তারিখ থেকে সমস্ত ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, একটু হলেও স্বস্তি পেলাম। কিছু মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচার-আচরণ আর পৃথিবী জুড়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা এই রোগের পরিস্থিতিতে দেশের বর্ডার সিল করাটা খুব দরকার ছিল। আরও সঠিক মনে হল, যখন ২৪ তারিখ থেকে আগামী ২১ দিনের জন্য পুরো দেশে লক ডাউন ঘোষণা করা হল। যার ফলে দেশের মধ্যে সমস্ত রেল, বাস, প্লেন ট্র্যাভেল বন্ধ, কোনরকম সামাজিক বা ধর্মীয় জমায়েত নিষিদ্ধ হল। এতে করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার হারটা কমবে, কিন্তু এর সাথে দরকার প্রচুর পরিমাণে টেস্ট করা, চেক আপ করা, অসুস্থ হলেই উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সে সবই হবে নিশ্চয়, অন্তত আশা তো করতে পারি। এ ছাড়া আর যে কোন উপায় নেই। যে উপায়ে এখানে কন্ট্রোল করতে দেখেছি, সেই একই রকম তৎপরতা নিজের দেশেও দেখতে চাই। যদিও এখানকার অথরিটিভ শাসন ব্যবস্থার সাথে আমার দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনেক তফাৎ, তবুও মানুষের নিজের জন্য ঘরে থাকাটা এখন খুব দরকার। বাড়িতে ফোন করলে এখন আমার জিজ্ঞাসা করার পালা, আর তার সাথে বার বার বলা, খুব দরকার না হলে বেরিয়ো না। বেরোলেও সব রকম সাবধানতা নিয়ে, ফিরে এসেও তাই। চিন্তা হচ্ছে খুব, বুঝতে পারছি কদিন আগেই এই চিন্তাটা তাদের হতো আমার জন্য।

        

কিন্তু এখন এখানে অনেকটা স্বাভাবিক। গত সপ্তাহে ইউনিভার্সিটির ভেতরের সুপার মার্কেটটা খুলে গেছে, আর তার সাথে উল্টো দিকের কেক-পাউরুটি র দোকানটাও। ব্রেকফাস্টের চিন্তাটা আর নেই। গত বৃহস্পতিবার আমাদের অফিসের সামনের ক্যান্টিনটাও খুলেছে। তবে সব জায়গাতেই চেক আপের বড্ড কড়াকড়ি। গত শুক্রবার হিসেব করে দেখলাম, সারা দিনে এখন আমার চার বার চেক হয়েছে – দুপুর বিকেলে ক্যান্টিনে, বাড়ি ফেরার সময় সুপার মার্কেটে, উল্টো দিকের কেকের দোকানে আরও একবার। ক্যান্টিনে এখন আর বসে খেতে দিচ্ছে না, খাবার নিয়ে বাড়ি বা অফিসে গিয়ে খেতে হচ্ছে। ভিড় হচ্ছে, কিন্তু এমন ভাবে ব্যারিকেড করা পুরো ক্যান্টিন জুড়ে, যে ভিড় গায়েই লাগছে না। ঢোকা-বেরোনোর সময় হাতে অ্যালকোহল, গরম খাবার আর পাঁচ মিনিটের বেশী কাউকে ভেতরে থাকতে না দেওয়া – সব মিলিয়ে পুরো ক্যান্টিনের চেহারাটাই পালটে গেছে। কাল থেকে আর দুপুরে বাড়ি আসবো না ঠিক করেছি। দুটো টিফিন বক্স নিয়ে যাবো, একটাতে লাঞ্চ নিয়ে অফিসে এসে খাবো, আর বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় রাতের খাবারটা নিয়ে বাড়ি ঢুকব একেবারে। তবে ইউনিভার্সিটির ক্লাস এখনও শুরু হয়নি, মনে হয়না মে মাসের আগে শুরু হবে বলে। বাইরে বেরিয়ে দেখেছি, সব দোকান মোটামুটি খুলেছে। যেটার জন্য সব থেকে বেশী অপেক্ষা ছিল, সেই সেলুন খুলেছে। মাথায় চুলের বোঝা আর রাখা যাচ্ছিল না। সেই নভেম্বর মাসে প্যারিস যাবার আগে চুল কেটেছিলাম, আর তারপর কাটলাম গতকাল। চুল এত বড় হয়ে গেছিলো যে সেদিন আমাদের ল্যাবের একজন স্টুডেন্ট আমার কাছে কি একটা কাজে এসে জিজ্ঞাসা করলো ‘তুমি কি সেলুন খুঁজে পাচ্ছ না? যদি বল, তো আমি তোমাকে সেলুন খুঁজতে হেল্প করতে পারি’। একজন মেয়ের এই প্রশ্নের পর, সেই রাতেই বসের টেক্সট, ‘তোমার কি একটা সেলুনের খোঁজ পেলে ভালো হয়? আসলে এখানে এতদিন সব বন্ধ তো, তাই আমরা ভাবলাম যদি তোমার এই ব্যাপারে কোন অসুবিধা হয়ে থাকে’। তাদের দুজনকেই আমি জানাতে বাধ্য হলাম যে আমি যে সেলুন থেকে গত দু-বছর ধরে চুল কাটাই, সেটা এতদিন বন্ধ ছিল, কিন্তু এখন খুলে গেছে, আমি দেখে এসেছি। এই সপ্তাহের শেষেই আমি চুল কেটে ফেলব। বাড়ির লোক ছাড়া অন্য কারুর কাছ থেকে চুল কাটার কথা শোনা, এই অভিজ্ঞতাও আমার প্রথম। তাই আর দেরী না করে, চুল কাটিয়ে ফেলেছি, মাথাটা হাল্কা হয়েছে। নতুন করে শহরে বা গোটা গুয়াংডং প্রদেশে সংক্রমণের সংখ্যা কমেছে, যা কিছু রিপোর্ট হচ্ছে, সবই বাইরে থেকে দেশে ফেরা মানুষ জনের মধ্যে। তাই এই মাসের প্রথম থেকে সমস্ত যাত্রীদের কোয়ারানটাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সে যে দেশেরই মানুষ হোক না কেন। আস্তে আস্তে সেই নিয়ম আরও কঠিন হতে হতে গত ২৬ তারিখে সমস্ত বিদেশী নাগরিকের এই দেশে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই এখন চি এখানে আসার বায়না করলে, যেমনটা করে চলেছে শেষ দু মাস ধরে, আমি বলতে পারি, যে আর কোন উপায় নেই। যদিও যখন উপায় ছিল, তখনও যে আমি ওকে আসতে দিতাম, তা সম্ভব ছিল না। যে দেশ থেকে লোক জন পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল, সেখানে ওকে নিয়ে আসার কোন কারণই আমার কাছে জোরাল বলে মনে হয়নি কোনদিন। তাই কষ্ট হলেও, একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন অনুভব করেও, তখন সিদ্ধান্ত না পাল্টানোর জন্য আজও আমার কোন অনুতাপ নেই।

কালকের সপ্তাহ থেকে আবার পুরনো অভ্যাসে ফেরার চেষ্টা শুরু করব। সেই সকালে অফিস যাওয়া, বিকেলে বাড়ি ফেরা, কফি খেয়ে সিনেমা দেখা, আর ডিনার সেরে পরের দিন সকালে উঠতে হবে মনে করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া। সপ্তাহে একদিন বাইরে যাওয়া, স্টারবাকস এর কফি বা কোনোদিন পিৎজা খেয়ে বাড়ি ফেরা, সবই হবে, তবে একলা। এই জিনিসটা পাল্টাতে পারবো না, অন্তত এখন তো নয়ই। সেদিনটার অপেক্ষা করি, যেমন করে চলেছি সেই গত বছরের জুলাই থেকে, আর আশা করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবাই যেন ফিরতে পারে তাদের পুরনো রুটিনে। ঠিক করেছি, ২৫ শে জানুয়ারী যে পিৎজা না কিনে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল, আজ সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে সেটাই কিনে আনবো। এখন লেখা থামাই, আবার পরে লিখতে বসব।

3.jpg

সকালে জানালার কাঁচ শোনায় সারাটা দিনের গল্প

13.JPG

সন্ধ্যেবেলায় নদীর পারে

শেষের কথা

নিজের ডায়েরির পাতাগুলো এই সুযোগে আরও একবার পড়ার পর মনে হচ্ছে, এই শেষ তিন মাস, মানে জানুয়ারী থেকে মার্চ, আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। তাই, লেখার শেষে একটা সারাংশ জুড়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। আসলে অভ্যেস – যখনই কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখি, তার প্রথমে একটা সারাংশ লিখতে হয়, এ সেই অভ্যেসেরই ফল। সেটা লিখতে বসে এই তিন মাসে পাওয়া-হারানোর হিসেবটা করতে খুব ইচ্ছে করছিল। আর সেই হিসেবটা করতে গিয়ে বারবার মনে পড়ছে আগন্তুক সিনেমার সেই সংলাপ – ‘স্ট্রাগল, বাঙ্গালির এক অতি প্রিয় শব্দ, আমি অবশ্য ওটাকে স্ট্রাগল বলি না, বলি মগজের পুষ্টি, মাংস পেশীর পুষ্টি আর মানুষ চেনার পথে প্রথম পদক্ষেপ’। দ্বিতীয়টা কতদূর হয়েছে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি এখনও, কিন্তু প্রথম আর শেষের দুটির সাফল্য নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

এক ভাইরাস আক্রান্ত শহরে, বর্তমান পৃথিবীর রোগাক্রান্ত মানচিত্রে এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল থেকে মাত্র চারশো কিলোমিটার দূরে বসে, এই তিন মাস আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। দিকনির্দেশহীন এই তিন মাস আমি কাজে লাগিয়েছি আমার নিজের মত করে। ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্টদের না থাকার সুবাদে নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ এগিয়ে গেছে অনেকটা। অপর্যাপ্ত অবসর সময়ে কতদিন আগে কাজের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি লেখার অভ্যেসটা নিজের অজান্তেই কবে যেন ফেরত এসেছে। একলা থাকার যে শিক্ষায় বোম্বেতে প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল, এই তিন মাসে তা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। এই সময়ে আমি রান্না করতে শিখেছি, কখনও চি এর কাছ থেকে রেসিপি জেনে আবার কখনও ইন্টারনেট ঘেঁটে, মাঝে মাঝে নিজের হাতের রান্না খেয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেছি। এই তিন মাসে চাপ হয়েছে মাঝে মাঝে বেশ কিছুটা, মনে হয়েছে অনেকবার বাড়ি চলে যাই, সব ঠিক ঠাক হলে আবার আসবো। কোনোদিন জ্বর-জ্বর মত মনে হয়েছে, এদিকে ঘরে চাল নেই, কিন্তু বাইরে যেতে পারছি না এই ভয়ে যে গেলেই ধরা পরে যাবো আর তারপরেই হাসপাতালে যেতে হবে। এই অবস্থায় ক্যালপল খেয়ে কেটেছে দু-তিনটে দিন। খুব ঠাণ্ডা কোন সন্ধ্যে বেলায় কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে রান্না করতে হবে আর তারপর সেই বাসন মাজতে হবে মনে করে রাতে ছাতু, মুড়ি, কলা খেয়ে শুয়ে পড়েছি, এরকম অনেকবার হয়েছে। কিন্তু তাও পালিয়ে যেতে মন চায়নি। ধীরে ধীরে বুঝেছি, কাউকে ভালবাসলে যেমন তার ভালোটাও বাসতে হয়, তেমনই খারাপটাও নিতে হয়। এই শহরের সাথে আমার ভালো লাগাটা বেড়ে উঠেছে শেষ দু বছর ধরে একটু একটু করে, তাকে এই সময়ে ফেলে চলে যেতে পারিনি। অনেকবার মনটা বাড়ি যাবার জন্য পাগলামি করেছে, একটু কিছু অন্যরকম খাবার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু কোনবারই, বাড়ির লোকগুলোকে অযথা বিপদের মুখে ফেলার রিস্ক নেওয়ার কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। আজ নিজেরই ভালো লাগে আমার মনের এই অচেনা দিক গুলোর পরিচয় পেয়ে। আজ যখন দেখছি, যারা বাড়ি চলে গেছিল আর এখন ফিরতে চাইছে কিন্তু ফিরতে পারছে না, তাদের কাজ আটকে আছে বলে ওখান থেকে হাত কামড়ানো ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই, আর এদিকে অনেক স্কুল, কলেজ যে বিদেশীরা বাড়ি চলে গেছিল তাদের ফিরতে বারণ করে দিয়েছে, মাইনে কমিয়েছে, তখন মনে হচ্ছে ওই সময়ের সিদ্ধান্তটা ঠিকই ছিল।

অন্যদিকে এই সময় আমি যে সাহায্য আর সহযোগিতা ইউনিভার্সিটি, আমার বসের কাছ থেকে পেয়েছি, সেটাও আমার দেশে ফেরত যাওয়ার পথে মস্ত বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি নিশ্চিত, যদি আমি এই সিদ্ধান্ত নিতাম, তাহলে আমার বস ই সবার আগে আমার টিকিটের ব্যবস্থা করতেন, কিন্তু কি বলতাম আর কি ভাবেই বা বলতাম ওনাকে, সেটাই আর গুছিয়ে ওঠার সুযোগ পাইনি। এতদিন ওনার সাথে কাজ করে যে মানুষটাকে চিনেছি, তার দেওয়া আশ্বাস ঝেড়ে ফেলে বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার কথা আর ভাবতে পারিনি। আরও সত্যি বললে, খালি মনে হয়েছে, যদি লোকজন ভাবে যে আমি ভীতু, ভারতীয়রা বোধ হয় এরকমই হয়। যতদিন বা যতবার দেশের বাইরে গেছি, সব সময় মনে রেখেছি, আমি আমার দেশের প্রতিনিধি, আমার কোন কাজে বা আচার-ব্যবহারে যেন আমার দেশের কোন বদনাম না হয়। সেই চেষ্টা আমি এখানে নিরন্তর করে চলি, আর তাই এবারও সেই চেষ্টাই অন্যতম প্রধান একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার দেশে না ফেরার। অফিসের জুনিয়র কলিগ, স্টুডেন্ট যারা এই সময় এখানে ছিল, তারা সবাই দেখা হলে বা টেক্সট করে নিয়মিত খোঁজ নিয়েছে, কোন অসুবিধা হলে তাদের সাহায্য সব সময় পেয়েছি। আরও অবাক হয়েছি যখন মা বা নি এর কাছ থেকে শুনেছি এমন কিছু লোক আমার খোঁজ নিয়েছেন, যাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না বহুদিন। তারা জানতে পেরেছেন খবরের কাগজে, ফেসবুক মারফৎ। এদের মধ্যে যেমন আত্মীয়-স্বজনরা আছেন, তেমনই পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো এই সুযোগে আবার খুঁজে পাওয়া গেছে - এটাই বা কম কি?

তাই পাওয়া-হারানোর তুলনাটা এখানে অবান্তর। এই তিন মাসে আমি নিজেকে চিনেছি আরও বেশ কিছুটা। সময়-অসময়ের মন খারাপ গুলো বাদ দিলে, হারানোর পাল্লায় চাপানোর মতো আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার এক অতি প্রিয় বন্ধু এই সময়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি লাভ পাচ্ছিস ওখানে পড়ে থেকে? বাড়ি চলে আয়।’ মনে আছে, ঠাট্টা করে বলেছিলাম ‘আরে আগের বছর ঘূর্ণি ঝড়, আর এই বছর এপিডেমিকের নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এই জিনিস কি করে মিস করি বল’। আজ সত্যি মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস মিস করিনি।

Subscribe for updates

Thanks for submitting!

© 2020 by Achyut K Banerjee. Proudly created with Wix.com

  • Instagram
  • Facebook

You are visitor number...

bottom of page